বইটিকে বলা যেতে পারে জঙ্গলমহলে বার বার ফিরে আসা এক বহিরাগতের ডায়রি৷ জঙ্গলমহলের কথা আজ প্রায় প্রতিনিয়তই সংবাদমাধ্যমে শোনা যায়৷ অথচ মাত্র বছর দশেক আগেও বিষয়টা ঠিক এ রকম ছিল না৷ জঙ্গলমহলের কথা এই সেদিনও খোঁজখবর নিতেন মূলত কিছু অত্যুত্সাহী পর্যটক অথবা হাতে গোনা কয়েকটি এনজিও৷ ২০০৪ সালে জঙ্গলমহলেরই একটি গ্রাম আমলাশোলের নাম হঠাত্ সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে৷ খবর বেরয় সেখানে আদিবাসী মানুষেরা বছরের পর বছর অভুক্ত আছেন৷ মৃত্যু হচ্ছে অনাহারে৷ সেই নিয়ে খুব একচোট বাকবিতণ্ডা শুরু হয়৷ তত্কালীন শাসক সিপিআই (এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট --- যাঁদের সে সময় ছিল জঙ্গলমহলে প্রায় একচ্ছত্র রাজনৈতিক আধিপত্য প্রথমে এ খবর মানতেই চাননি৷ পরে অবশ্য সারা বিশ্বের দৃষ্টি পড়ে আমলাশোলে৷ এই সময়েই লেখকেরও জঙ্গলমহল তথা আমলাশোল যাত্রার শুরু৷ সেই থেকে ২০১২ বার বার তিনি ফিরে গিয়েছেন জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকায়৷ ছবিটা কতটা বদলেছে?
২০ অগস্ট, ২০১১ সালে সেই আমলাশোলে ফিরে গিয়েই লেখক যা দেখেছেন তা এ রকম, 'গৃহকত্রী মালতী শবর কয়েকদিন আগে মারা গেছেন৷ বাড়ির কর্তা লুলু শবর মোহন শবরের বাড়িতে বসে মদ খাচ্ছেন৷ আর লুলুর সন্তান-সন্ততিরা? বছর দশেকের তনু একটি বাটি নিয়ে বসে আছে৷ তাতে জল ভর্তি সেই জলে লেবু চিপড়ানো৷ সেই লেবুজল তনু সহ আরও দু'টো ভাইবোন খাওয়ার জন্য হামলে পড়েছে৷ ভাতের বদলে শুধু লেবুজল নিয়ে তিন ভাইবোনে বাঁচার লড়াই চলছে৷' বইটির শেষ অধ্যায়ে আছে ২০১১ সালের এই যাত্রার নাতিদীর্ঘ বর্ণনা৷ বিগত দু'বছরে খুব কি বদলে গিয়েছে ছবিটা? হয়তো নয়৷ তবু লেখকের ধারণা 'নিঃশব্দে কোথাও একটা বিপ্লব চলছে৷ এর জন্য কাউকে গুলি ছুঁড়তে হয়নি৷ এর জন্য কাউকে মরতে হয়নি৷ এর জন্য কোনও মায়ের কোল খালি করতে হয়নি৷' স্পষ্টতই লেখকের ইঙ্গিত মাওবাদী বিদ্রোহের পথে এই নিঃশব্দ বিপ্লব আসছে না৷ এই বইয়ে লেখক যে কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বলেছেন তা নয়৷ মাঝে মাঝেই তিনি ব্যক্তি থেকে চলে গিয়েছেন ব্যষ্টিতে৷ যেমন প্রথম অধ্যায়ে আমলাশোলের কেন্দোগোড়ার মদন শবরের বাড়ি যাওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেষ করেই দীপককুমার ২০০৪-এর আমলাশোলের অনাহারে মৃত্যু নিয়ে নানা তথ্য তুলে ধরেছেন৷ সেই প্রসঙ্গে যেমন এসেছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের উদ্ধৃতি তেমনই আছে মানবাধিকার সংস্থা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির প্রতিবেদনের অংশ৷ যেহেতু আমলাশোলের আদিবাসীদের অনেকেই শবর লেখক পাঠককে পরিচিত করিয়ে দিতে চেয়েছেন শবরদের ইতিহাস ও বর্তমানের সঙ্গেও৷
গোটা বইটি জুড়েই আছে জঙ্গলমহলের এ রকম নানা নৈর্ব্যক্তিক ঐতিহাসিক ও সামাজিক বিবরণ এবং সেই বিবরণে উঠে আসা তথ্যগুলি যে সঠিক যেন তা প্রমাণ করতেই লেখক আমাদের শুনিয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলি৷ এ ভাবেই আমরা বিখ্যাত আদিবাসী বুদ্ধিজীবী রামদয়াল মুণ্ডার বাবা সতীশ মুণ্ডার মুখে শুনতে পাই, 'যত দুঃখ কষ্ট থাক আমাদের আনন্দ ফুর্তি আছে৷ সারা বছর আমাদের নানা পরব৷ পরবের মধ্যেই সব ভুলে থাকে৷' এই ভাবেই আমরা জেনে ফেলি ১লা বৈশাখ চড়ক গাজন দিয়ে এই এলাকার পরবের শুরু৷ জ্যৈষ্ঠে 'রোহিন' হয়৷ আষাঢে় অম্বুবাচি৷ শ্রাবণে গমাপরব৷ ভাদ্রে করমপূজা৷ আশ্বিনে কাঠিনাচ৷ কালিপুজোর আগে গট পূজা৷ কার্তিকে গোহাল পূজা, ইত্যাদি৷ চতুর্থ পরিচ্ছেদে এসে পাই আমলাশোল অঞ্চলে শুরু হওয়া নানা উন্নয়নের কড়চা৷ সেটা ২০০৮৷ মনে রাখা যেতে পারে ততদিনে জঙ্গলমহলের ক্ষোভ জমতে জমতে বারুদের স্তপে পরিণত হয়েছে৷ ২০০৮-এর শেষ থেকেই তা প্রবল প্রতিবাদে ফেটে পড়ে৷ কাজেই এই উন্নয়নের প্রয়াস খানিকটা মরণকালে রাম নামের মতো কি না সে প্রশ্ন থেকে যেতেই পারে৷
এর পর ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ এসেছে রাজনৈতিক পরিবর্তন৷ এই পরিবর্তনের কী ছবি দেখেছেন জঙ্গলমহলে লেখক? উনত্রিশতম অধ্যায়ে লেখক যে ছবি আঁকেন তা খুব হতাশার নয় --- ২৮ অক্টোবর , ২০১২ আমলাশোলে গিয়ে দেখলাম কেন্দোগোড়ায় স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় একটা কালভার্ট হয়েছে৷ ... রাত্রে নতুন পাড়ায় দেখলাম লক্ষ্মীপ্রিয়া মুড়া মুখ বুজে পড়ছে৷ ... ও মেদিনীপুর নার্সিং কলেজে বিএসসি নার্সিং-এর ছাত্রী৷ ... পরের দিন কলকাতায় ফিরব৷ ... আমাদের সঙ্গে কলকাতায় এল মুখি আর ফুলমণি শবর৷ রাস্তায় ওদের কথা শুনছি৷ ওরা এখন অনেক সরব৷
২০ অগস্ট, ২০১১ সালে সেই আমলাশোলে ফিরে গিয়েই লেখক যা দেখেছেন তা এ রকম, 'গৃহকত্রী মালতী শবর কয়েকদিন আগে মারা গেছেন৷ বাড়ির কর্তা লুলু শবর মোহন শবরের বাড়িতে বসে মদ খাচ্ছেন৷ আর লুলুর সন্তান-সন্ততিরা? বছর দশেকের তনু একটি বাটি নিয়ে বসে আছে৷ তাতে জল ভর্তি সেই জলে লেবু চিপড়ানো৷ সেই লেবুজল তনু সহ আরও দু'টো ভাইবোন খাওয়ার জন্য হামলে পড়েছে৷ ভাতের বদলে শুধু লেবুজল নিয়ে তিন ভাইবোনে বাঁচার লড়াই চলছে৷' বইটির শেষ অধ্যায়ে আছে ২০১১ সালের এই যাত্রার নাতিদীর্ঘ বর্ণনা৷ বিগত দু'বছরে খুব কি বদলে গিয়েছে ছবিটা? হয়তো নয়৷ তবু লেখকের ধারণা 'নিঃশব্দে কোথাও একটা বিপ্লব চলছে৷ এর জন্য কাউকে গুলি ছুঁড়তে হয়নি৷ এর জন্য কাউকে মরতে হয়নি৷ এর জন্য কোনও মায়ের কোল খালি করতে হয়নি৷' স্পষ্টতই লেখকের ইঙ্গিত মাওবাদী বিদ্রোহের পথে এই নিঃশব্দ বিপ্লব আসছে না৷ এই বইয়ে লেখক যে কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বলেছেন তা নয়৷ মাঝে মাঝেই তিনি ব্যক্তি থেকে চলে গিয়েছেন ব্যষ্টিতে৷ যেমন প্রথম অধ্যায়ে আমলাশোলের কেন্দোগোড়ার মদন শবরের বাড়ি যাওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেষ করেই দীপককুমার ২০০৪-এর আমলাশোলের অনাহারে মৃত্যু নিয়ে নানা তথ্য তুলে ধরেছেন৷ সেই প্রসঙ্গে যেমন এসেছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের উদ্ধৃতি তেমনই আছে মানবাধিকার সংস্থা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির প্রতিবেদনের অংশ৷ যেহেতু আমলাশোলের আদিবাসীদের অনেকেই শবর লেখক পাঠককে পরিচিত করিয়ে দিতে চেয়েছেন শবরদের ইতিহাস ও বর্তমানের সঙ্গেও৷
গোটা বইটি জুড়েই আছে জঙ্গলমহলের এ রকম নানা নৈর্ব্যক্তিক ঐতিহাসিক ও সামাজিক বিবরণ এবং সেই বিবরণে উঠে আসা তথ্যগুলি যে সঠিক যেন তা প্রমাণ করতেই লেখক আমাদের শুনিয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলি৷ এ ভাবেই আমরা বিখ্যাত আদিবাসী বুদ্ধিজীবী রামদয়াল মুণ্ডার বাবা সতীশ মুণ্ডার মুখে শুনতে পাই, 'যত দুঃখ কষ্ট থাক আমাদের আনন্দ ফুর্তি আছে৷ সারা বছর আমাদের নানা পরব৷ পরবের মধ্যেই সব ভুলে থাকে৷' এই ভাবেই আমরা জেনে ফেলি ১লা বৈশাখ চড়ক গাজন দিয়ে এই এলাকার পরবের শুরু৷ জ্যৈষ্ঠে 'রোহিন' হয়৷ আষাঢে় অম্বুবাচি৷ শ্রাবণে গমাপরব৷ ভাদ্রে করমপূজা৷ আশ্বিনে কাঠিনাচ৷ কালিপুজোর আগে গট পূজা৷ কার্তিকে গোহাল পূজা, ইত্যাদি৷ চতুর্থ পরিচ্ছেদে এসে পাই আমলাশোল অঞ্চলে শুরু হওয়া নানা উন্নয়নের কড়চা৷ সেটা ২০০৮৷ মনে রাখা যেতে পারে ততদিনে জঙ্গলমহলের ক্ষোভ জমতে জমতে বারুদের স্তপে পরিণত হয়েছে৷ ২০০৮-এর শেষ থেকেই তা প্রবল প্রতিবাদে ফেটে পড়ে৷ কাজেই এই উন্নয়নের প্রয়াস খানিকটা মরণকালে রাম নামের মতো কি না সে প্রশ্ন থেকে যেতেই পারে৷
এর পর ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ এসেছে রাজনৈতিক পরিবর্তন৷ এই পরিবর্তনের কী ছবি দেখেছেন জঙ্গলমহলে লেখক? উনত্রিশতম অধ্যায়ে লেখক যে ছবি আঁকেন তা খুব হতাশার নয় --- ২৮ অক্টোবর , ২০১২ আমলাশোলে গিয়ে দেখলাম কেন্দোগোড়ায় স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় একটা কালভার্ট হয়েছে৷ ... রাত্রে নতুন পাড়ায় দেখলাম লক্ষ্মীপ্রিয়া মুড়া মুখ বুজে পড়ছে৷ ... ও মেদিনীপুর নার্সিং কলেজে বিএসসি নার্সিং-এর ছাত্রী৷ ... পরের দিন কলকাতায় ফিরব৷ ... আমাদের সঙ্গে কলকাতায় এল মুখি আর ফুলমণি শবর৷ রাস্তায় ওদের কথা শুনছি৷ ওরা এখন অনেক সরব৷
No comments:
Post a Comment