সুমন চট্টোপাধ্যায়
নরেন্দ্র দামোদর মোদী তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাতে 'রাম-রাজ্য' স্থাপন করেছেন এ কথা জানানোর জন্য তাঁর কলকাতায় আসার সম্ভবত কোনও প্রয়োজন ছিল না৷ কেননা ব্যাপারটা তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের অভীপ্সার মতোই সুবিদিত, বহুচর্চিত, কোনও কোনও মহলে উচ্চ-প্রশংসিত, কোনও কোনও মহলে আবার ধিক্কৃত৷ যে রাজ্যে রহিমের কোনও জায়গা নেই, থাকলেও সেই অবস্থান সঙ্কুচিত অথবা ভীত-সন্ত্রস্ত সেই ভূখণ্ড 'রাম-রাজ্য' ছাড়া আবার কী!
কিন্তু কলকাতায় এসে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী এই মুহূর্তে দিল্লি-বাসিনী বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে এ ভাবে ব্যাট ধরবেন, কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা অভিযোগগুলি আরও সুললিত এবং সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে তাঁর কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হবে, এটা কিছুটা অপ্রত্যাশিত ছিল৷ অতএব নরেন্দ্রর কলকাতা সফরের একমাত্র অনুচ্চারিত রাজনৈতিক বার্তাটি হল এই রকম৷ ২০১৪-র লড়াইয়ে তিনি বাংলার ভগিনীর সমর্থন প্রত্যাশী৷
কাগজে কলমে হয়তো বলা যাবে না, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর বাসনা একেবারেই অমূলক, বিশেষ করে মমতার রাজনৈতিক অতীতের দিকে চোখ রাখলে৷ অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারকে যিনি একদা সমর্থন করে থাকতে পারেন তিনি তাঁর উত্তরসূরির অলিভ-শাখাকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনবেন না, এ কথা কি এখনই জোর গলায় বলা যায়? ক্ষমতার রাজনীতির ঘূর্ণায়মান কালচক্রে চির-শত্রু বলে কেউ থাকতে পারে না, সব সিদ্ধান্তই সময়ের আপাত-বাধ্যবাধকতার অনিবার্য ফসল৷ বিশেষ করে তালগোল পাকিয়ে যাওয়া কোয়ালিশনের জমানায়, যেখানে শরিক-বদল আর মহিলাদের শাড়ি-বদল প্রায় সমার্থক হয়েই দাঁড়িয়েছে৷
যদিও যে সময়ে এবং যে কারণে বাজপেয়ীর এনডিএ সরকারে মমতা শরিক হয়েছিলেন তার সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির আদৌ কোনও মিল নেই৷ প্রথমত অটলবিহারীর ঢঙে নরেন্দ্র মোদী ভাষণ দেওয়ার চেষ্টা করলেও সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে দু'জনের মধ্যে কার্যত কোনও মিল নেই৷ গেরুয়া শিবিরে বাজপেয়ী বরাবরই নরমপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, ব্যক্তিগত ভাবে ততটা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না এবং সেই কারণে লখনউয়ের মতো লোকসভা আসনেও তিনি সংখ্যালঘুদের ভোট পেতেন৷ মোদীর অবস্থান একেবারে বিপরীত মেরুতে৷ ২০০২-এর সরকারি-দাঙ্গা এগারো বছর পরে এখনও তাঁকে ভূতের মতো তাড়া করে বেড়ায় সর্বত্র৷ এই ভাবমূর্তি দিয়ে দেশের হিন্দু-ভোট মোদী সংগঠিত করতে পারবেন কীনা, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ থাকলেও তাঁকে দেখে সর্বত্র সংখ্যালঘুদের ভোট যে বিজেপি-র বিরুদ্ধে চোখের লহমায় সংগঠিত হয়ে যাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ বাজপেয়ীকে সমর্থন করার রাজনৈতিক মূল্যটা ঠিক কী হতে পারে তাঁর মতো করে মমতা তা বিলক্ষণ বুঝেছেন৷
আর মোদীকে সমর্থন করার মানে তো মা মনসার ঘরে ধুনোর গন্ধ নিয়ে আসা৷ ফলে মমতা বারে বারে বেলতলায় যেতে চাইবেন কি না সেটাই তো একটা বড়ো প্রশ্ন৷ কেননা, সবার উপরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বোঝেন, তাঁর রাম-রাজ্যে রহিমদের কতটা বোলবোলা! তবু নরেন্দ্র দামোদর মোদী এত আগে থেকেই বা দান ছেড়ে দেবেন কেন? ফলে, সোমবার সকালে কলকাতার বণিক-সমাবেশে (শহরের বেশ কয়েকজন পরিচিত ব্যবসায়ী দিদির চক্ষুশূল হওয়ার ভয়ে যেটা এড়িয়ে গিয়েছেন) তিনি প্রথমেই জানিয়ে দিলেন, মিডিয়াকে খুশি করতে তিনি নিজের রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা টানবেনই না৷ বরং এত অল্প দিনে কোনও রাজ্য সরকারের কৃতকর্মের সঠিক মূল্যায়নই যে করা যায় না সেটাই তিনি বুঝিয়ে দিলেন দুই রাজ্যের অভিজ্ঞতার সাযুজ্যের প্রসঙ্গ টেনে৷ মোদী বললেন, গুজরাতে তাঁর কংগ্রেসি পূর্বসূরিরা রাজ্য-জুড়ে যে সব গর্ত খুঁড়ে গিয়েছিলেন সেগুলি ভরাট করতেই তাঁর দশ-দশটি বছর সময় লেগে গিয়েছে৷ আর পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের বত্রিশ বছরের (পরিসংখ্যানটা যদিও ভুল) অপশাসনে বামেরা যে কত গর্ত খুঁড়েছেন তার কোনও গোনা-গুনতিই নেই৷ অতএব মোদী ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিলেন, অসময়ে অসতর্ক মন্তব্য করে সস্তা হাততালি কুড়োনোর বান্দা তিনি নন, এখনই মমতার গোঁসার কারণ হতেও তিনি চান না৷ তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া, প্রথম ল্যাপ দৌড়েই হোঁচট খেতে চান না৷
বরং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতি-নিয়ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে সব অভিযোগ করে থাকেন, তাঁর সরকারের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীও সে সব কথাই বলে গেলেন সাজিয়ে গুছিয়ে৷ বললেন, কেন্দ্রে বাজপেয়ীর সরকার থাকাকালীন বিরোধীদের রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কোনও বৈষম্য করা হয়নি৷ আদর্শ ও মতবাদের প্রশ্নে বিরুদ্ধ শিবিরে থাকা পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সরকারও তেমন অভিযোগ করার সুযোগ পায়নি সে সময়ে৷ কিন্তু কংগ্রেসের নীতিই হল নিজেদের সরকারের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করে বিরোধীদের সঙ্গে ক্রমাগত অসহযোগিতা করা৷ এমনকী তিন-চতুর্থাংশ সমর্থন নিয়ে যে সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে তাদের পাশ করা বিলও কেন্দ্র সময়ে অনুমোদন করে না৷ যত রকম ভাবে সম্ভব বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করে৷ মমতার মতো মোদীরও অভিযোগ কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার পক্ষাঘাতে আক্রান্ত, তারা নিজেরা কোনও সিদ্ধান্ত নেয় না, অন্যকে সিদ্ধান্ত নিতে দেয় না, কোনও সুপরামর্শে কর্ণপাতও করে না৷ বাড়িতে অসুস্থ রোগী যেমন ভাবে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সন্ধ্যা নামার অপেক্ষা করে, মনমোহন সিংয়ের সরকারের আচরণও অনেকটা সেই রকম৷ মোদী জানিয়ে দেন, তিনি চান এই ব্যবস্থার বদল৷ এটা যে অকংগ্রেসি প্রতিটি রাজ্য সরকারেরই দাবি, বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, সেটাও তিনি বিলক্ষণ বোঝেন৷
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভাষণ দিলেন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সমাবেশে, যেটা দেশের প্রতিটি প্রান্তেই এখন মোদীর সবচেয়ে কাছের 'কনস্টিটুয়েন্সি৷' কেননা শিল্পোন্নয়নের পোস্টার বয় হিসেবে মনমোহন-চিদাম্বরমকে তিনি অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছেন সেই কবেই৷ অতএব এ শহরের শিল্প মহলের আশা ছিল তিনি তাঁর শিল্পোন্নয়নের মডেল ব্যাখ্যা করবেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে যেখানে জমি ছোট ছোট জোতে বিভক্ত সেখানে শিল্পের বিকাশ কী ভাবে করা সম্ভব তা নিয়ে তাঁর মতামতও জানাবেন৷ অথচ সতর্ক মোদী শিল্প-সমাবেশে দাঁড়িয়েও সে রাস্তা মাড়ালেনই না৷ সিঙ্গুর থেকে ন্যানোর সানন্দে চলে যাওয়ার কাহিনি নিয়ে উচ্চারণ করলেন না একটি শব্দও৷ বরং কেন্দ্রীয় সরকারের তুলোধোনা করা ছাড়া ভাষণের বেশির ভাগ সময়টা জুড়ে তিনি বর্ণনা করলেন গুজরাতে কৃষির বিকাশের কথা৷ কী ভাবে তিনি ক্ষুদ্র সেচের ব্যবস্থা করেছেন, কী ভাবে রাজ্যের সব গ্রামে আলো জ্বালিয়েছেন, কী ভাবে তুলোর রফতানি বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের এক তরফা ফতোয়াকে গ্রাহ্য না করে বাঁচিয়েছেন রাজ্যের বস্ত্র-শিল্পকে৷ মোদী বলেছেন, গুজরাতই দেশের একমাত্র রাজ্য যেখানে কৃষকদের প্রত্যেকের কাছে এমন একটি 'হেলথ-কার্ড' আছে যেখানে তাঁর জমির স্বাস্থ্য সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য লিপিবদ্ধ করা থাকে৷ সেখানে কীসের চাষ হতে পারে, কী কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে, কী ভাবে ঊর্বরতা বাড়ানো যেতে পারে ইত্যাদি৷ কৃষি ক্ষেত্রের অঙ্গ হিসেবে গুজরাতে তাঁর সরকার খামার তৈরি ও পশুপালনের উপর কতটা গুরুত্ব দিয়েছে সবিস্তারে তা-ও বোঝালেন মোদী৷ জানালেন, গুজরাতই একমাত্র রাজ্য যেখানে সরকারি তত্ত্বাবধানে গরু-ছাগলেরও চোখের ছানি অপারেশন হয়৷ অর্থাত্ শিল্পের বিকাশ-পুরুষ হিসেবে শিল্প-শ্মশান পশ্চিমবঙ্গে এসে এবং সেইজন্যই যাবতীয় কৌতূহল সৃষ্টি করে নরেন্দ্র মোদী তুলে ধরতে চাইলেন তাঁর তুলনায় অপরিচিত কিষান-দরদি ছবিটাই৷ সেই অর্থে হল যেটা, তাকে পর্বতের মূষিক প্রসব বললেও বোধহয় অতিরঞ্জন হয় না৷
হতে পারে, মমতার রাজ্যে দাঁড়িয়ে তাঁর বিরাগভাজন হতে না চাওয়ার বাইরেও মোদীর আরও একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য আছে৷ তা হল, তিনি যে কেবল টাটা-বিড়লা-আম্বানিদের হাততালি পাওয়ার যোগ্য নন, গরিব মানুষেরও হিতাকাঙ্খী, প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে নামার আগে নিজের সেই মূর্তিটিও সযত্নে তুলে ধরার চেষ্টা করা৷ 'ইন্ডিয়া শাইনিং' স্লোগান তুলে বিজেপির কী হাল হয়েছিল মোদী তা জানেন৷ তিনি এটাও জানেন, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের স্তুতি তাঁকে আর যাই হোক দিল্লির সাউথ ব্লকে বসাতে পারবে না৷ যাঁরা পারবেন তাঁদের কাছে গুজরাতের শিল্প-বিকাশের কাহিনি আর চন্দ্রপৃষ্ঠে চাষ-আবাদ হওয়ার গল্প একই ব্যাপার৷ অতএব, যত দিন যাবে, মোদীকে তত বেশি করে দেখা যাবে গরিব-বন্ধু হতে৷ হতে পারে, নিজের নতুন মূর্তি নির্মাণের সেই কাজটি তিনি কলকাতা থেকেই শুরু করলেন৷
নরেন্দ্র দামোদর মোদী তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাতে 'রাম-রাজ্য' স্থাপন করেছেন এ কথা জানানোর জন্য তাঁর কলকাতায় আসার সম্ভবত কোনও প্রয়োজন ছিল না৷ কেননা ব্যাপারটা তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের অভীপ্সার মতোই সুবিদিত, বহুচর্চিত, কোনও কোনও মহলে উচ্চ-প্রশংসিত, কোনও কোনও মহলে আবার ধিক্কৃত৷ যে রাজ্যে রহিমের কোনও জায়গা নেই, থাকলেও সেই অবস্থান সঙ্কুচিত অথবা ভীত-সন্ত্রস্ত সেই ভূখণ্ড 'রাম-রাজ্য' ছাড়া আবার কী!
কিন্তু কলকাতায় এসে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী এই মুহূর্তে দিল্লি-বাসিনী বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে এ ভাবে ব্যাট ধরবেন, কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা অভিযোগগুলি আরও সুললিত এবং সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে তাঁর কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হবে, এটা কিছুটা অপ্রত্যাশিত ছিল৷ অতএব নরেন্দ্রর কলকাতা সফরের একমাত্র অনুচ্চারিত রাজনৈতিক বার্তাটি হল এই রকম৷ ২০১৪-র লড়াইয়ে তিনি বাংলার ভগিনীর সমর্থন প্রত্যাশী৷
কাগজে কলমে হয়তো বলা যাবে না, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর বাসনা একেবারেই অমূলক, বিশেষ করে মমতার রাজনৈতিক অতীতের দিকে চোখ রাখলে৷ অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারকে যিনি একদা সমর্থন করে থাকতে পারেন তিনি তাঁর উত্তরসূরির অলিভ-শাখাকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনবেন না, এ কথা কি এখনই জোর গলায় বলা যায়? ক্ষমতার রাজনীতির ঘূর্ণায়মান কালচক্রে চির-শত্রু বলে কেউ থাকতে পারে না, সব সিদ্ধান্তই সময়ের আপাত-বাধ্যবাধকতার অনিবার্য ফসল৷ বিশেষ করে তালগোল পাকিয়ে যাওয়া কোয়ালিশনের জমানায়, যেখানে শরিক-বদল আর মহিলাদের শাড়ি-বদল প্রায় সমার্থক হয়েই দাঁড়িয়েছে৷
যদিও যে সময়ে এবং যে কারণে বাজপেয়ীর এনডিএ সরকারে মমতা শরিক হয়েছিলেন তার সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির আদৌ কোনও মিল নেই৷ প্রথমত অটলবিহারীর ঢঙে নরেন্দ্র মোদী ভাষণ দেওয়ার চেষ্টা করলেও সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে দু'জনের মধ্যে কার্যত কোনও মিল নেই৷ গেরুয়া শিবিরে বাজপেয়ী বরাবরই নরমপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, ব্যক্তিগত ভাবে ততটা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না এবং সেই কারণে লখনউয়ের মতো লোকসভা আসনেও তিনি সংখ্যালঘুদের ভোট পেতেন৷ মোদীর অবস্থান একেবারে বিপরীত মেরুতে৷ ২০০২-এর সরকারি-দাঙ্গা এগারো বছর পরে এখনও তাঁকে ভূতের মতো তাড়া করে বেড়ায় সর্বত্র৷ এই ভাবমূর্তি দিয়ে দেশের হিন্দু-ভোট মোদী সংগঠিত করতে পারবেন কীনা, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ থাকলেও তাঁকে দেখে সর্বত্র সংখ্যালঘুদের ভোট যে বিজেপি-র বিরুদ্ধে চোখের লহমায় সংগঠিত হয়ে যাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ বাজপেয়ীকে সমর্থন করার রাজনৈতিক মূল্যটা ঠিক কী হতে পারে তাঁর মতো করে মমতা তা বিলক্ষণ বুঝেছেন৷
আর মোদীকে সমর্থন করার মানে তো মা মনসার ঘরে ধুনোর গন্ধ নিয়ে আসা৷ ফলে মমতা বারে বারে বেলতলায় যেতে চাইবেন কি না সেটাই তো একটা বড়ো প্রশ্ন৷ কেননা, সবার উপরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বোঝেন, তাঁর রাম-রাজ্যে রহিমদের কতটা বোলবোলা! তবু নরেন্দ্র দামোদর মোদী এত আগে থেকেই বা দান ছেড়ে দেবেন কেন? ফলে, সোমবার সকালে কলকাতার বণিক-সমাবেশে (শহরের বেশ কয়েকজন পরিচিত ব্যবসায়ী দিদির চক্ষুশূল হওয়ার ভয়ে যেটা এড়িয়ে গিয়েছেন) তিনি প্রথমেই জানিয়ে দিলেন, মিডিয়াকে খুশি করতে তিনি নিজের রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা টানবেনই না৷ বরং এত অল্প দিনে কোনও রাজ্য সরকারের কৃতকর্মের সঠিক মূল্যায়নই যে করা যায় না সেটাই তিনি বুঝিয়ে দিলেন দুই রাজ্যের অভিজ্ঞতার সাযুজ্যের প্রসঙ্গ টেনে৷ মোদী বললেন, গুজরাতে তাঁর কংগ্রেসি পূর্বসূরিরা রাজ্য-জুড়ে যে সব গর্ত খুঁড়ে গিয়েছিলেন সেগুলি ভরাট করতেই তাঁর দশ-দশটি বছর সময় লেগে গিয়েছে৷ আর পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের বত্রিশ বছরের (পরিসংখ্যানটা যদিও ভুল) অপশাসনে বামেরা যে কত গর্ত খুঁড়েছেন তার কোনও গোনা-গুনতিই নেই৷ অতএব মোদী ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিলেন, অসময়ে অসতর্ক মন্তব্য করে সস্তা হাততালি কুড়োনোর বান্দা তিনি নন, এখনই মমতার গোঁসার কারণ হতেও তিনি চান না৷ তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া, প্রথম ল্যাপ দৌড়েই হোঁচট খেতে চান না৷
বরং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতি-নিয়ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে সব অভিযোগ করে থাকেন, তাঁর সরকারের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীও সে সব কথাই বলে গেলেন সাজিয়ে গুছিয়ে৷ বললেন, কেন্দ্রে বাজপেয়ীর সরকার থাকাকালীন বিরোধীদের রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কোনও বৈষম্য করা হয়নি৷ আদর্শ ও মতবাদের প্রশ্নে বিরুদ্ধ শিবিরে থাকা পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সরকারও তেমন অভিযোগ করার সুযোগ পায়নি সে সময়ে৷ কিন্তু কংগ্রেসের নীতিই হল নিজেদের সরকারের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করে বিরোধীদের সঙ্গে ক্রমাগত অসহযোগিতা করা৷ এমনকী তিন-চতুর্থাংশ সমর্থন নিয়ে যে সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে তাদের পাশ করা বিলও কেন্দ্র সময়ে অনুমোদন করে না৷ যত রকম ভাবে সম্ভব বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করে৷ মমতার মতো মোদীরও অভিযোগ কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার পক্ষাঘাতে আক্রান্ত, তারা নিজেরা কোনও সিদ্ধান্ত নেয় না, অন্যকে সিদ্ধান্ত নিতে দেয় না, কোনও সুপরামর্শে কর্ণপাতও করে না৷ বাড়িতে অসুস্থ রোগী যেমন ভাবে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সন্ধ্যা নামার অপেক্ষা করে, মনমোহন সিংয়ের সরকারের আচরণও অনেকটা সেই রকম৷ মোদী জানিয়ে দেন, তিনি চান এই ব্যবস্থার বদল৷ এটা যে অকংগ্রেসি প্রতিটি রাজ্য সরকারেরই দাবি, বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, সেটাও তিনি বিলক্ষণ বোঝেন৷
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভাষণ দিলেন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সমাবেশে, যেটা দেশের প্রতিটি প্রান্তেই এখন মোদীর সবচেয়ে কাছের 'কনস্টিটুয়েন্সি৷' কেননা শিল্পোন্নয়নের পোস্টার বয় হিসেবে মনমোহন-চিদাম্বরমকে তিনি অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছেন সেই কবেই৷ অতএব এ শহরের শিল্প মহলের আশা ছিল তিনি তাঁর শিল্পোন্নয়নের মডেল ব্যাখ্যা করবেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে যেখানে জমি ছোট ছোট জোতে বিভক্ত সেখানে শিল্পের বিকাশ কী ভাবে করা সম্ভব তা নিয়ে তাঁর মতামতও জানাবেন৷ অথচ সতর্ক মোদী শিল্প-সমাবেশে দাঁড়িয়েও সে রাস্তা মাড়ালেনই না৷ সিঙ্গুর থেকে ন্যানোর সানন্দে চলে যাওয়ার কাহিনি নিয়ে উচ্চারণ করলেন না একটি শব্দও৷ বরং কেন্দ্রীয় সরকারের তুলোধোনা করা ছাড়া ভাষণের বেশির ভাগ সময়টা জুড়ে তিনি বর্ণনা করলেন গুজরাতে কৃষির বিকাশের কথা৷ কী ভাবে তিনি ক্ষুদ্র সেচের ব্যবস্থা করেছেন, কী ভাবে রাজ্যের সব গ্রামে আলো জ্বালিয়েছেন, কী ভাবে তুলোর রফতানি বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের এক তরফা ফতোয়াকে গ্রাহ্য না করে বাঁচিয়েছেন রাজ্যের বস্ত্র-শিল্পকে৷ মোদী বলেছেন, গুজরাতই দেশের একমাত্র রাজ্য যেখানে কৃষকদের প্রত্যেকের কাছে এমন একটি 'হেলথ-কার্ড' আছে যেখানে তাঁর জমির স্বাস্থ্য সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য লিপিবদ্ধ করা থাকে৷ সেখানে কীসের চাষ হতে পারে, কী কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে, কী ভাবে ঊর্বরতা বাড়ানো যেতে পারে ইত্যাদি৷ কৃষি ক্ষেত্রের অঙ্গ হিসেবে গুজরাতে তাঁর সরকার খামার তৈরি ও পশুপালনের উপর কতটা গুরুত্ব দিয়েছে সবিস্তারে তা-ও বোঝালেন মোদী৷ জানালেন, গুজরাতই একমাত্র রাজ্য যেখানে সরকারি তত্ত্বাবধানে গরু-ছাগলেরও চোখের ছানি অপারেশন হয়৷ অর্থাত্ শিল্পের বিকাশ-পুরুষ হিসেবে শিল্প-শ্মশান পশ্চিমবঙ্গে এসে এবং সেইজন্যই যাবতীয় কৌতূহল সৃষ্টি করে নরেন্দ্র মোদী তুলে ধরতে চাইলেন তাঁর তুলনায় অপরিচিত কিষান-দরদি ছবিটাই৷ সেই অর্থে হল যেটা, তাকে পর্বতের মূষিক প্রসব বললেও বোধহয় অতিরঞ্জন হয় না৷
হতে পারে, মমতার রাজ্যে দাঁড়িয়ে তাঁর বিরাগভাজন হতে না চাওয়ার বাইরেও মোদীর আরও একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য আছে৷ তা হল, তিনি যে কেবল টাটা-বিড়লা-আম্বানিদের হাততালি পাওয়ার যোগ্য নন, গরিব মানুষেরও হিতাকাঙ্খী, প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে নামার আগে নিজের সেই মূর্তিটিও সযত্নে তুলে ধরার চেষ্টা করা৷ 'ইন্ডিয়া শাইনিং' স্লোগান তুলে বিজেপির কী হাল হয়েছিল মোদী তা জানেন৷ তিনি এটাও জানেন, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের স্তুতি তাঁকে আর যাই হোক দিল্লির সাউথ ব্লকে বসাতে পারবে না৷ যাঁরা পারবেন তাঁদের কাছে গুজরাতের শিল্প-বিকাশের কাহিনি আর চন্দ্রপৃষ্ঠে চাষ-আবাদ হওয়ার গল্প একই ব্যাপার৷ অতএব, যত দিন যাবে, মোদীকে তত বেশি করে দেখা যাবে গরিব-বন্ধু হতে৷ হতে পারে, নিজের নতুন মূর্তি নির্মাণের সেই কাজটি তিনি কলকাতা থেকেই শুরু করলেন৷
No comments:
Post a Comment