লতিফ সিদ্দিকীর ৪৬ অনিয়ম
কোনো নিয়মই মানেন না মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী থাকার সময় সব ধরনের আইনকানুন, নিয়মনীতি ভঙ্গ করে তিনি সরকারি সম্পত্তি হস্তান্তর করেছেন। আইন বা নীতিমালা মানার ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য ছিল 'নীতিমালা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ কর।
রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গঠিত উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি বলেছে, পাঁচ বছরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ৪৮টি সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে হস্তান্তর বা বিক্রি করেছে। এ সময় দুটি ছাড়া বাকি সব প্রতিষ্ঠান বিনা দরপত্রে, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, বিনা মূল্যে বা কম মূল্যে বেসরকারীকরণ বা বিক্রি করা হয়। সেই সময়ের বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড করেছেন।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এখন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ধর্মসহ বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য তিনি সব মহলে সমালোচিত হচ্ছেন। এর আগেও তিনি সমালোচিত ছিলেন নানা ধরনের অনিয়মের জন্য। এ কারণে গত ২২ ফেব্রুয়ারি তাঁর মন্ত্রণালয়ের ওপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কমিটি গঠন করা হয়। মূলত বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সম্পত্তি বেসরকারীকরণের ক্ষেত্রে আইন ও বিধি মানা হয়েছে কি না এবং চুক্তির শর্ত মেনে সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর হয়েছে কি না, তা যাচাই করার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক পবন চৌধুরীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি গত ৩১ আগস্ট বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর নানা অনিয়মের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
লতিফ সিদ্দিকীকে সরানোর গুঞ্জনপ্রতিবেদনে কমিটি সুপারিশ করে বলেছে, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ও বিনা মূল্যে বা কম মূল্যে যেসব সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয়েছে, সেগুলো আবার রাষ্ট্রের অনুকূলে ফেরত আনার বিষয়টি যাচাই করে দেখতে হবে। এ ছাড়া কমিটি 'রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি জনগণের সম্পত্তি' মন্তব্য করে জনস্বার্থ ক্ষুণ্নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদনটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব ফণীভূষণ চৌধুরী গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, 'প্রতিবেদনটি মাত্রই আমরা হাতে পেয়েছি। প্রতিবেদনে যে সুপারিশগুলো করা হয়েছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে আমরা কাজ শুরু করেছি। যারাই সম্পত্তি হস্তান্তর বা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেপ্তার দাবি এরশাদেরপ্রতিবেদনে বলা হয়, মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে (২০০৯-১৩) বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের বিটিএমসি, তাঁত বোর্ড, বিলুপ্ত জুট করপোরেশন (বিজেসি) এবং বিজেএমসির মোট ৪৮টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ ও হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ঈগল স্টার টেক্সটাইল মিলের ঋণের সুদ মওকুফ করা হয়। ৩০টি প্রতিষ্ঠান পূর্ণাঙ্গ হস্তান্তর করা হয়েছে, ১৭টি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াধীন। এর মধ্যে বিনা দরপত্রে দেওয়া হয়েছে ১২টি। এভাবে সম্পত্তি হস্তান্তরের কারণে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। তা ছাড়া, এ ক্ষেত্রে বেসরকারীকরণ কমিশন আইন ও নীতিমালাও মানা হয়নি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪৬টি প্রতিষ্ঠান বা ভূমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে করা অনিয়মগুলো হচ্ছে: যথাযথ মূল্য নির্ধারণ না করা, বিনা দরপত্রে হস্তান্তর, কেবল মন্ত্রীর সিদ্ধান্তে বিনা মূল্যে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া, বিক্রির আগে অর্থনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন না নেওয়া, বিক্রির শর্ত না মানা, আইনগত জটিলতা নিরসন না করেই হস্তান্তর ইত্যাদি।
লতিফ সিদ্দিকীর সমালোচনায় বিএনপিসাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, 'প্রতিবেদনে যা তুলে ধরা হয়েছে এবং নোটশিটে তিনি যা লিখেছেন, তাতে পরিষ্কারই বোঝা যায় যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী কাউকে পরোয়া করেননি। তিনি ইচ্ছেমতো ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা হবে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
সুদ মওকুফ: চট্টগ্রামের ঈগল স্টার টেক্সটাইলের কাছে সরকারের পাওনা বিপুল অঙ্কের সুদ একক সিদ্ধান্তে মওকুফ করেন মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। সরকারের পাওনা ছয় কোটি ৬২ লাখ টাকা। এই মিলের দায়দেনা মওকুফের জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হলে লিখিতভাবে জানানো হয়, 'মওকুফের ক্ষমতা এককভাবে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর নেই। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মন্ত্রিসভার অনুমতি লাগবে।' কিন্তু নথিটি মন্ত্রীর কাছে গেলে লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে সিদ্ধান্ত দেন, 'এই মিলের দায়দেনা সরকারের মালিকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি, তাই মূল অর্থ ও সুদ মাফ করা যায়।' কিন্তু এর পরেও ওই মালিক আসল টাকা পরিশোধ না করে এখনো মিলটি ভোগদখল করছেন।
মুখফোঁড় নেতারা এমন কথা বলতে পারেন: সাজেদাএকক সিদ্ধান্তে বিক্রি: কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলস লিমিটেড লোকসানের কারণে ১৯৮২ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ১৯৮৪ সালে মিলটি বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে নজরুল ইসলামে নামের এক ব্যক্তি সেটি কিনে নিয়ে নামকরণ করেন শাহ মখদুম টেক্সটাইল মিলস। তখন মিলটির বিক্রয়মূল্য ছিল ১১ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল প্রায় ১৩ কোটি টাকা। নজরুল ইসলাম টাকা ঠিকমতো পরিশোধ করতে না পারায় দরপত্র বাতিল করা হলে তিনি আদালতে মামলা করেন। ২০০৯ সালে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি ফয়সালার নির্দেশ দিলে মামলা প্রত্যাহারের শর্তে ওই প্রতিষ্ঠানকে কিস্তি, দায়দেনাসহ ৪৯ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য বলা হয়। পরে শাহ মখদুম টেক্সটাইল মিলের পক্ষে দ্য পিপলস ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন নামে একটি মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান টাকা পরিশোধে রাজি হয়। কিন্তু মামলা প্রত্যাহার বা টাকা পরিশোধ না করায় মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী মিলটি ফেরত না নিয়ে একক সিদ্ধান্তে আবদুল মতিন নামের আরেক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রির নির্দেশ দেন। শেষ পর্যন্ত তিনিও কোনো টাকা পরিশোধ করেননি। এরপর এনারগোটেক নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক আরিফুর রহমানের সঙ্গে মিলটি বিক্রির জন্য চুক্তি করা হয়। তিনিও সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করেননি। এরপর অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বারবার মিলটি বেসরকারি কমিশনের কাছে ন্যস্ত করার কথা বললেও মন্ত্রী নিজেই মিলটি বিক্রির কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন।
এখনো তাঁর মন্ত্রী থাকা আশ্চর্যের বিষয়: বি চৌধুরীকমিটি বলেছে, বিক্রির পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিল অবৈধ। এ ছাড়া মিলটি প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে।
অবৈধভাবে বিক্রয় ও হস্তান্তর: গাজীপুরের কালীগঞ্জের মসলিন কটন মিলটি বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনকে (বিজিএমসি) ন্যস্ত করা হয়। এর পরও ২০১১ সালে এটি রিফাদ নামে একটি পোশাক কারখানার কাছে ১৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়, যা সম্পূর্ণ বেআইনি বলে মন্তব্য করেছে তদন্ত কমিটি। কমিটির মতে, মিলটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হস্তান্তর করা ছাড়াও এর দায়দেনা ও মূল্য যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয়নি।
সমঝোতা করে সম্পত্তি বিক্রি: বিলুপ্ত বিজেসির সম্পত্তি পাট বেলিং কেন্দ্র খুলনার দৌলতপুরে অবস্থিত। এই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ২০০৯ সালে সম্পত্তিটির দাম ধরা হয় ১৪ কোটি ৪২ হাজার ২১৩ টাকা। কিন্তু বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে উত্তরা জুট ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সুজিত কুমার ভট্টাচার্য সর্বোচ্চ দাম দেন পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। কিন্তু এই দর প্রস্তাব নাকচ করা হলে সুজিত কুমার সম্পত্তিটি পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ টাকায় কেনার জন্য মন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন। মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী তা অনুমোদন দেন।
কমিটির মতে, মন্ত্রীর নির্দেশমতো সবকিছু হয়েছে। তা ছাড়া, সমঝোতার মাধ্যমে দাম ঠিক করে জমি বিক্রি করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিটি।
যুক্তরাষ্ট্রে লতিফ সিদ্দিকীর মন্তব্যে ক্ষোভ, প্রতিবাদপ্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ছাড়া নেত্রকোনার সাবেক জুট বোর্ড ও বগুড়ার সুরজমহল আগরওয়ালা মিলটি দরপত্র ছাড়াই বিক্রি করা হয়েছে। আর কুড়িগ্রামের ঘেঊরচাঁদ মাঙ্গিলাল জমিটি নিষ্কণ্টক না করে দরপত্র আহ্বান ও বিক্রি করেছে মন্ত্রণালয়। আবার তাঁত বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন নোয়াখালীর টেক্সটাইল ফ্যাসিলিটিজ সেন্টারের জমি দরপত্র মূল্য অনুযায়ী না নিয়ে অনেক কম মূল্য হস্তান্তর করা হয়েছে।
কমিটি আরও বলেছে, শ্রমিক ও কর্মচারীদের কাছে হস্তান্তর করা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটের ফ্যারিলিন সিল্ক মিলস নীতিমালা ভেঙে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে অবস্থিত নিউ লক্ষ্মী কটন মিলটিও চুক্তি ও নীতিমালাবহির্ভূতভাবে তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শর্ত ভঙ্গ করলে চুক্তি বাতিল ও মিল অধিগ্রহণের নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি।
লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগ দাবি বিএনপিরএ ছাড়া টঙ্গীর নিশাত জুট মিলের কিছু জমি মতিঝিলে মধুমতি সিনেমা হলের পাশে ছিল। সেই জমি ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির হাসপাতাল বানানোর জন্য ৯৯ বছরের জন্য এক লাখ এক হাজার ১০১ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। গণপূর্ত ও গৃহায়ণ মন্ত্রণালয় প্লটটি বিক্রি বা হস্তান্তর না করার শর্ত দিয়েছিল। তার পরও ইজারা দেওয়া হয় এবং জমির মূল্যও নির্ধারণ হয়নি। এর কারণ হিসেবে মন্ত্রী লিখেছেন, '....ব্যক্তিগত জীবনে আমি চট্টলা কন্যার পাণি গ্রহণ করেছি।....মানবতার সেবায় তাদের সহযোগিতা করার নৈতিক দায়িত্ববোধ করছি।'
কমিটির মতে, কুমিল্লার দৌলতপুরের চিশতী টেক্সটাইল মিলস বিনা দরপত্রে ও কম মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটের ন্যাশনাল কটন মিল বিক্রির আগে অর্থনৈতিক মন্ত্রিসভা কমিটির মতামত নেওয়া হয়নি, রাজধানীর হাটখোলার ঢাকেশ্বরী কটন মিলটি বিনা মূল্যে হস্তান্তর করা হয়েছে, নাসিরাবাদের ভ্যালিকা উলেন মিল বাস্তব মূল্য অপেক্ষা কম মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে, জামালপুরের আর সিম প্রেস হাউস বিক্রির ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ফেনীর রানীর হাটের দোস্ত টেক্সটাইল হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও বেসরকারীকরণ কমিশন আইন ও নীতিমালা মানা হয়নি।
No comments:
Post a Comment