Memory lane: Bangladesh politricks in 1972-75
Kai Káús
# ০১
"... সৈয়দ নজরুল ইসলাম্, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ. এইচ. এম কামরুজ্জামান, এই লেখক শেখ আবদুল আজিজ ও আবদুস সামাদ আজাদ এ ৬ জনকে ১৯৭৫ সালের ২৩ আগস্ট এক সাথে গ্রেফতার করে পল্টনে কন্ট্রোল রুমে একটি ভাঙা বাড়িতে নেয়া হয়। আমরা বসা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি সৈয়দ আহমদ তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য জনৈক কর্নেল ফারুককে অনুরোধ করেছিলেন। কর্নেল ফারুক উত্তরে বলেছিলেন, আপনাদের সবার ট্রায়াল এখানে হবে। You will be tried first. আমাদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল – You will have to justify your corruption. এ কথা শুনে আমরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, এটা কোর্ট না, আদালত না, কিভাবে এখানে বিচার হবে? এই পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যে পরস্পরের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ইতিমধ্যে মেজর ডালিম এসে এইচ. এম. কামরুজ্জামানের সাথে আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগল। কামরুজ্জামান ডালিমকে বলেছিল, "এ রকম তো কথা ছিল না"? তারপর ডালিম চলে গেল। জ্ঞানী পাঠক এ কথা দ্বারা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন॥"
- শেখ আবদুল আজিজ (আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং মন্ত্রী) / রাজনীতির সেকাল ও একাল॥ [ দি স্কাই পাবলিশার্স - ফেব্রুয়ারী, ২০০৯ । পৃ: ৩৭৮ ]
# ০২
"... জনাব এ. এইচ. এম কামরুজ্জামান সাহেবের সরকারি বাসভবনে প্রায়ই জলসা বসে। ১৯৭৫ সন। ১৪ই আগস্ট। রাত। সেদিনও তার বাসায় সঙ্গীতের আসর। অনেক রাত হলো। আসর জমে উঠল। এমন সময় মেজর (অব:) ডালিম ঘরে ঢুকল। বলল জরুরি কথা আছে। কামরুজ্জামান সাহেব তখন গানের সুরে জমে আছেন। বলল, রাখ তোর জরুরি কথা। ডালিমের কথায় পাত্তা দিলেন না কামরুজ্জামান সাহেব। বললেন, সকালে আসিস॥"
- অধ্যাপক আবু সাইয়িদ (সাবেক তথ্যমন্ত্রী) / ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস : বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড॥ [ চারুলিপি - জুলাই, ২০১০ । পৃ: ১১৪ ]
#০৩
"... তবে হেনা ভাই (মন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান) আমাকে জানান বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে হেনা ভাইয়ের তিন নম্বর রোডের (ধানমন্ডি) বাসায় ডালিম তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। ডালিম তাকে ডেকেছে। হেনা ভাই নামেননি। হেনা ভাই বললেন, ডালিম আমার সাথে আগেও যোগাযোগ করেছিল এবং প্রস্তাবও নিয়ে এসেছিল। তাই জানতাম, সে কি কথা বলতে এসেছিল। তাই দরজা খুলিনি। হেনা ভাই আমাকে বললেন, ডালিমরা জানিয়েছিল এ রকম একটা ঘটনা ঘটবে। বঙ্গবন্ধুকে খুন করা হবে তা বলেনি - তবে তাকে বাসা থেকে নিয়ে যাবে এবং আবার হেনা ভাইয়ের নেতৃত্বে পাওয়ার নেয়া হবে। হেনা ভাই আমাকে বললেন, 'আমি তাতে তখন রাজী হইনি। ১৪ই আগস্ট তারিখে তাই নিচে নামিনি। ডালিম পরে গালাগালি করে চলে যায়।'
১৩ কিংবা ১৪ই আগস্ট ১৯৭৫ তারিখেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের বাসায় যাই। উনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পুরাতন গণভবনে থাকেন। তখন সন্ধ্যা হয়েছে। আমি দেখি উনি পাঞ্জাবী পরে পায়চারী করছেন। সালাম দিলাম। কোন উত্তর দিলেন না। খুব গম্ভীর। উনিতো এমনি একটু কম শুনতেন।
তিনি খুব লার্নড লোক ছিলেন, কিন্তু শেষের দিকে খুব মন খারাপ করে অভিমান করে থাকতেন। তার কারণ আর একদিন সময় করে বলব। যখনই তিনি দেখলেন বঙ্গবন্ধু কারও প্রভাবে এমন একটা পথে গেছেন, যে পথ আমাদের কারও জন্য ভাল ও কল্যাণ বয়ে আনবে না, তখনই তিনি অভিমান করে দূরে সরে থাকতেন। সেটা আরও খারাপ হলো আমাদের জন্য। বঙ্গবন্ধুর অন্তরের বন্ধু প্রকৃত পক্ষে সৈয়দ সাহেব ছিলেন। সৈয়দ নজরুল সাহেব কি ভাবছেন? কি করছেন? প্রশ্নের জবাবে বললাম, স্যার কি হয়েছে?
তিনি বললেন, 'কী হতে বাকি আছে? আমাদের পায়ের তলায় মাটি নেই - নিজেদের ঘর সামলাতে পার না, আমরা আবার কথা বলি।' তখন বুঝলাম উনি তো খুব রেগে আছেন। কারণ জানি না। চিন্তা করার জন্য বললাম, 'স্যার উপরে চলুন, চা খাব।' উপরে গেলাম। দুই জনে উপরে এক ঘরে বসলাম।
'এই দেখেন আমি আপনাকে বলি নাই আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে? দিনের পর দিন কি হচ্ছে? কেউ কথা শুনে না আমার, কারও কথা শুনে না। এখন কি অবস্থা হবে?'
আমি বললাম, কি হয়েছে? কী হবে?
নজরুল সাহেব বললেন, 'পায়ের তলায় মাটি আছে?' আমি বললাম, 'স্যার কার কথা বলছেন আপনি?' সৈয়দ সাহেব বললেন, 'কার আবার?' বঙ্গবন্ধুর কথা বলছেন। আমি বললাম, 'কেন? কি হয়েছে?' বললেন, 'যা দেখছি এতো ভালো মনে হচ্ছে না। আমার কাছে লোক আসছিল। আমার কাছে পাওয়ার দেবার প্রস্তাব নিয়ে আসছিল। কেন? কামরুজ্জামান হেনা সাহেবও ঐ দিন আমাকে বলেছিলেন আজও উনি আমাদের নেতা। ওনাকে দিয়ে চলবে না। ক্ষমতা আমাকে নিতে হবে। এটা কেমন কথা। উনিতো আমার সঙ্গে আলাপ করতে চান না।'
আমি বললাম, 'আপনি ৩২ নম্বর যান। সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলেন। দেখেন কী করতে পারেন।'
সৈয়দ সাহেব বললেন, 'না। তিনি যখন সব কথা খুলে বলতে চান না, তখন আর কী করব।'
তখন আমি বললাম, 'তাহলেতো চলবে না। আপনার জন্য আপনি না যান, দেশের জন্য, আমাদের জন্য যান। আজকে যাবেন।' তিনি বললেন, 'না।'
তারপর ঠিক হলো পরদিন উনি যাবেন। সে সুযোগ মনে হয় আর হয়নি। হেনা ভাই আর সৈয়দ সাহেবের কথায় মনে হয় খন্দকার মোশতাক সাহেব ছাড়াও অন্য যে কাউকে দিয়ে তারা টেক ওভার করে ফেলতো॥"
[ একান্ত সাক্ষাৎকারে বাকশাল ও মোশতাক মন্ত্রীসভায় মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী ]
তথ্যসূত্র: অধ্যাপক আবু সাইয়িদ (সাবেক তথ্যমন্ত্রী) / ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস : বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড॥ [ চারুলিপি - জুলাই, ২০১০ । পৃ: ২৮৬-২৮৮ ]
#০৪
"... ১৯৭৫ সালের ৪ঠা ও ৫ই নভেম্বর আলম ( আতিকুল আলম। ১৯৭১ সালে রয়টার্স ও বিবিসিঽর স্থানীয় সংবাদদাতা) স্থানীয় কূটনৈতিক মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি তথাকথিত গোপনীয় চিঠি প্রদর্শন করে। চিঠিখানি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাজউদ্দিন আহমদ লিখেছেন বলে সে দাবী করে। ঢাকায় নিয়োজিত ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনের নিকট লিখিত এই চিঠিতে নাকি ক্যু অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা এবং এ সম্পর্কিত আয়োজনের কথা উল্লেখ করা হয়। জার্মান দূতাবাসের কূটনৈতিক অফিসারদের চিঠিখানি দেখিয়ে আলম অবিচলিতভাবে দাবী করে, তাজউদ্দিনের স্বহস্তে লিখিত এই চিঠি, খালেদ মোশাররফ কর্তৃক অনুষ্ঠিত ক্যু'র সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জড়িত বলে প্রমাণ করে। বিদেশী কূটনৈতিক অফিসারদের আলম বলে ভারত-সমর্থক তাজউদ্দিন আহমদকে জেল থেকে বের করে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিষ্ঠা করাই এই ক্যু'র উদ্দেশ্য। আলম কর্তৃক এই চিঠি প্রদর্শনের ফলে ক্যু'র সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ জড়িত বলে দূতাবাস এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে॥" (মূল: অসমাপ্ত বিপ্লব / লরেন্স লিফশুলৎস)
- আবদুল মতিন । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়॥ [ রেডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৩ । পৃ: ২৪৭-২৪৮]
#০৫
"... প্রধানমন্ত্রী সেদিন যশোহর ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনী পরিদর্শন করে এসেছেন। উৎপাদনশীল কাজে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। তাদের দ্বিতীয় বিপ্লবের ক্যাডার হওয়ার উপদেশ দিয়ে এসেছেন। তিনি বেশ ক্লান্ত ছিলেন। আমার এই রিপোর্ট ( কলকাতায় ডালিমের সাথে জর্জ গ্রিফিনের সাক্ষাৎ) শোনার পর তিনি স্প্রীং এর মতো চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন। আমার হাত ধরে লনে নিয়ে এলেন। জিগ্গেস করাতে বলেছিলাম, খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ক্যু সংগঠিত হবে। তিনি নির্বাক হয়ে গেলেন।
বহুক্ষণ পায়চারী করার পর তিনি বললেন : ক্যু করলে মোশতাক করবে না - করবে তাজউদ্দিন॥"
- ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস : বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড / অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ॥ [ চারুলিপি - জুলাই, ২০১০ । পৃ: ১১০ ]
#০৬
"... হুদা বাতেনকে নিয়ে গণভবনের পেছনে একটা সেনা ক্যাম্পে গেলেন। সেখানে একটা ক্যানটিনে তাঁরা পরোটা-মাংস খেলেন। তারপর বাতেনকে আসাদগেটের কাছে নামিয়ে দিয়ে তাজউদ্দীনের বাসার দিকে রওনা হলেন। হুদা পরে তাজউদ্দীনের বাসায় তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বাতেনকে বলেছিলেন। তাজউদ্দীনকে হুদা সরকার গঠনের অনুরোধ জানালে তাজউদ্দীন জবাবে বলেছিলেন, 'শেখ মুজিবের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে আমি প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট হতে চাই না॥"
- জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি / মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক (প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য বই)
#০৭
"... ১৫ আগস্ট সকালে ঢাকা নগর গণবাহিনীর অন্যতম সদস্য মীর নজরুল ইসলাম বাচ্চুর নেতৃত্বে তিতুমীর কলেজের সহসভাপতি কামালউদ্দিন আহমদ, গণবাহিনীর আবদুল্লাহ আল মামুন, ওয়াহিদুল ইসলাম সুটুল ও রতন ধানমন্ডিতে তাজউদ্দীনের বাসায় যান। কামালের বাড়ি ঢাকার কাপাসিয়া থানায়। তাঁর বড় ভাই নৌবাহিনীর প্রাক্তন লিডিং সি-ম্যান সুলতানউদ্দিন আহমদ আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত এবং জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক ছিলেন। তাজউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর পূর্বপরিচয় ছিল এবং একই এলাকায় বাড়ি বলে তাঁদের মাঝেমধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হতো।
তাজউদ্দীনের বাসায় গিয়ে তাঁরা শুনলেন, তিনি গোসল করছেন। তাঁরা বাইরের ঘরে অপেক্ষা করতে থাকলেন। মিনিট দশেক পর তাজউদ্দীন এলেন। পরনে একটা পায়জামা, গায়ে হাতাওয়ালা গেঞ্জি। সিলিং ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে দুই হাতের আঙুল দিয়ে ব্যাকব্রাশের মতো ভঙ্গিতে চুল থেকে পানি ঝরাচ্ছিলেন। পানির ঝাপটা কামালের চোখে-মুখে এসে লাগছিল।
তাজউদ্দীন উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকলেন, 'বোকার দল লাল বাহিনী বানায়, নীল বাহিনী বানায়। কোনো বাহিনী তাঁকে বাঁচাতে পারল?'
বাচ্চু বললেন, 'আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।' তাজউদ্দীন বললেন, 'কোথায় যাব? কেন তোমাদের সঙ্গে যাব?' বাচ্চু বারবার বলছিলেন, 'যেতেই হবে।'
তাজউদ্দীন বললেন, 'এটা কারা করল? রাইটিস্টরা না লেফটিস্টরা? লেফটিস্টরা হলে আমাকে আর জীবিত রাখবে না।' লেফটিস্ট বলতে তিনি পিকিংপন্থীদের বোঝাচ্ছিলেন। বাচ্চুর কথার জবাবে তিনি বললেন, 'সিরাজ কোথায়? ও যদি বলে তাহলে যেতে পারি। তাকে নিয়ে আসো।' বাচ্চু বেরিয়ে গেলেন। আধঘণ্টা পর তিনি ফিরে এসে জানালেন, সিরাজুল আলম খান কোথায় আছেন, তা জানা যায়নি। বাচ্চু জানতেন না, তিনি দেশে নেই। অগত্যা তাজউদ্দীনকে ছাড়াই তাঁরা ফিরে এলেন॥"
- জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি / মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক (প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য বই)
#০৮
"... পয়লা নভেম্বর একটি মন্ত্রিসভায় খোন্দকার মোশতাক আহমেদ সভাপতিত্ব করেন। কিন্তু ঐ মন্ত্রিসভার কোন সিদ্ধান্ত কোথাও প্রকাশ পায়নি। পরে জানা যায়, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনা ছিল যে, তারা খোন্দকার মোশতাক আহমদকে দিয়ে একটা ঘোষণা জারি করবেন, যার বলে পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী দশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে এসে মুজিব আমলের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রেসিডেন্ট, এম. মনসুর আলীকে ভাইস প্রেসিডেন্ট, তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করে সংসদীয় পদ্ধতিতে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠণের সূচনা করবেন।
এ ধরণের একটি ঘোষণায় স্বাক্ষরদান করতে অস্বীকার করলে অন্য আরেকজন ব্রিগেডিযার খন্দকার মোশতাককে গুলি করতে উদ্যত হন। তখন বঙ্গভবনে ঘটনাস্থলে উপস্থিত মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও সাবেক মন্ত্রী জেনারেল ওসমানী অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং সবাইকে শান্ত করেন।
বঙ্গভবনে যখন এমনি এক টলটলায়মান উত্তপ্ত অবস্থা চলছে তখন এবং যখন শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকারী সেনাবাহিনীর অংশের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ দুই-একদিনের মধ্যেই ক্ষমতা গ্রহণ করবেন এবং আওয়ামী বাকশালী রাজত্ব পুন্:প্র্তিষ্ঠা হবে, তখন তারা বলপূর্বক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করে উপরোক্ত চারজন আওয়ামী লীগ নেতাকে ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে ৩ নভেম্বর হত্যা করে॥"
- সিরাজুল হোসেন খান ( প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং শ্রমিক নেতা, সাবেক মন্ত্রী ) / উপমহাদেশের সামাজিক- রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত ॥ [ঝিনুক প্রকাশ - ফেব্রুয়ারী, ২০০২ । পৃ: ২০০-২০২]
#০৯
"... ওয়ারেছাত হোসেন বেলাল, বীরপ্রতীক (জাসদের সুইসাইড স্কোয়াডের শীর্ষ নেতা। কর্ণেল তাহের ও শহীদ বাহারের ভাই। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাংসদ) স্মৃতিচারণ উপলক্ষে বলেন :
আমার মনে পড়ে ১৯৭৪ সালে যখন অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে প্রদান করা হয় তখন কর্ণেল ফারুক তার ব্যাটালিয়ান নিয়ে নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। কর্নেল তাহের তখন নারায়ণগঞ্জ ড্রেজারের ডাইরেক্টার। তার বাসায় এক দিন কর্নেল ফারুক একটি ফোক্সওয়াগেন গাড়ী নিয়ে হাজির। ড্যাসবোর্ডে একটি চাইনীজ পিস্তল । সোজাসুজি তিনি কর্নেল তাহেরকে বললেন, 'স্যার, এ পিস্তল দিয়ে আমি শেখ মুজিবকে হত্যা করবো। আপনি আর কর্নেল জিয়াউদ্দিন দেশ চালাবেন'॥" (আজকের কাগজ - ১৫ জানুয়ারী, ১৯৯২)
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় / আবদুল মতিন ॥ [ র্র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশান্স - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৩ । পৃ: ৫২ ]
#১০
"... ইত্তেফাকের সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি মঈনুল হোসেন (মানিক মিঞার ছেলে) পর্দার অন্তরালে থেকে মোশতাকের জন্য সমর্থন জোগানোর চেষ্টায় রত ছিলেন, কেননা তিনি রাজনৈতিকভাবে মোশতাকের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
অভ্যুত্থান সংঘটিত হবার পরে দৈনিক ইত্তেফাকের তরুণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (মঈনুল হোসেনের ছোট ভাই) দু'জন বিদেশী সংবাদদাতাকে বলেন, 'অভ্যুত্থানটি আমার কাছে মোটেই আকস্মিক ছিল না। কূটনৈতিক মহলে অনেকেই বেশ কিছুদিন যাবৎ এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করত। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে আমাকে একজন কূটনীতিক জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, এটা কি ডানপন্থী অভ্যুত্থান হবে না বামপন্থী অভ্যুত্থান হবে? অধিকমাত্রায় বামপন্থী বলে দাবীদার কিংবা কট্টর ডানপন্থীদের দ্বারাই একটি অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা নেয়া হতে পারে। একই নদীর মধ্যে উৎপন্ন হয়েও যেমন স্রোতের গতিপথ পরিবর্তিত হয়, ঠিক তেমনি এ দুই দলের উদ্দেশ্য এক হলেও পথ ছিল ভিন্ন।'
মঞ্জু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আরও বলেন, 'শেখ মুজিব যখন উপলব্ধি করতে পারলেন যে তিনি দেশের সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করতে পারবেন না তখনই তিনি আর বাঁচতে চাননি॥"
- এ. এল. খতিব / কারা মুজিবের হত্যাকারী ॥ [ অনুবাদ: সোয়াদ করিম। শিখা প্রকাশনী - ১৯৯২ । পৃ: ৩০-৩৮]
#১১
"... পনেরো আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে এরশাদের ঘনিষ্ঠতা ও তাদের প্রতি সহমর্মীতা লক্ষণীয়। পরবর্তী সময়ের দুটো ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমটি, খুব সম্ভবত:, মেজর জেনারেল জিয়ার সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পরবর্তী দ্বিতীয় দিনের ঘটনা। আমি সেনাপ্রধানের অফিসে তার উল্টোদিকে বসে আছি। হঠাৎ করেই রুমে ঢুকলেন সদ্য পদন্নোতি প্রাপ্ত ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল এরশাদ। এরশাদের তখন প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লিতে থাকার কথা।
তাকে দেখামাত্রই সেনাপ্রধান জিয়া বেশ রুঢ়ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি বিনা অনুমতিতে কেন দেশে ফিরে এসেছেন। জবাবে এরশাদ বললেন, তিনি দিল্লিতে অবস্থানরত তার স্ত্রীর জন্য একজন গৃহভৃত্য নিতে এসেছেন। এই জবাব শুনে জিয়া অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন, আপনার মতো সিনিয়র অফিসারদের এই ধরণের লাগামছাড়া আচরণের জন্যই জুনিয়র অফিসাররা রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখলের মতো কাজ করতে পেরেছে। জিয়া তার ডেপুটি এরশাদকে পরবর্তী ফ্লাইটেই দিল্লি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাকে বঙ্গভবনে যেতেও নিষেধ করলেন। এরশাদকে বসার কোন সুযোগ না দিয়ে জিয়া তাকে একরকম তাড়িয়েই দিলেন।
পরদিন ভোরে এরশাদ তার প্রশিক্ষণস্থল দিল্লিতে চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়ার নির্দেশ অমান্য করে রাতে তিনি বঙ্গভবনে যান। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থানরত অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর থেকেই মনে হয় এরশাদ আসলে তাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করার জন্যই ঢাকা এসেছিলেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো পরের। জিয়ার শাসনামলের শেষদিকের কথা। ঐ সময় বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী অফিসাররা গোপনে মিলিত হয়ে জিয়া সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করে। এক পর্যায়ে ওই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে তাদের সবাইকে ঢাকায় তলব করা হয়। সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে চক্রান্তকারী অফিসাররা যার যার দূতাবাস ত্যাগ করে লন্ডনসহ বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। এদিকে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে কর্মরত কয়েকজন সদস্য একই অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হন। আরো অনেকের সঙ্গে লে: কর্নেল দীদারের দশ বছর এবং লে: কর্নেল নুরুন্নবী খানের এক বছর মেয়াদের কারাদন্ড হয়। প্রধান আসামীরা বাংলাদেশের সরকার ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিদেশে নিরাপদেই অবস্থান করছিল। ঐ বিচার তাই একরকম প্রহসনেই পরিণত হয়।
পরবর্তীকালে, জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে যারা চাকরি করতে চেয়েছিলেন, এরশাদ তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। দ্বিতীয়বারের মতো পুনর্বাসিত হল ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা। পোস্টিং নিয়ে তাদের অনেকে বিভিন্ন দূতাবাসে যোগ দেয়।
শুধু পুনর্বাসনই নয়। এরশাদ আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত উল্লেখিত অফিসারদের কর্মস্থলে বিনাঅনুমতিতে অনুপস্থিতকালের প্রায় তিন বছরের পুরো বেতন ও ভাতার ব্যবস্থাও করে দেন। প্রায় একই সময়ে বিচারের হাত থেকে পালিয়ে থাকা ফেরারী প্রধান আসামীরা বিদেশী দূতাবাসে সম্মানজনক চাকরিতে নিযুক্ত হলেও একই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে কারাবন্দী থাক। কী অভিনব ও পক্ষপাতমূলক বিচার।
প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, অভুত্থানকারীদের প্রতি কি দায়বদ্ধতা ছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদের যে, কর্মস্থল ছেড়ে তিন বছর আইনের হাত থেকে পালিয়ে থাকার পরও ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের বিচার অনুষ্ঠান এড়িয়ে গিয়ে তাদেরকে আবার চাকরিতে পুনর্বহাল করলেন তিনি? ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হওয়াতেই অভ্যুত্থানকারীদের ঋণ শোধ করতে এরশাদ এ কাজ করেছিলেন কিনা, এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। ঘটনাপ্রবাহ থেকে একথা মনে করা মোটেই অযৌক্তিক নয় যে, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ও হত্যাকান্ডের পেছনে এরশাদের একটি পরোক্ষ কিন্তু জোরালো ভূমিকা ছিল॥"
- কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব:) / একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর ॥ [ সাহিত্য প্রকাশ - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৮ । পৃ: ১২০-১২১ ]
#১২
"... শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের 'প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের' শিকার হয়ে নিহত হয়েছিলেন। এ যুক্তি যারা দেন তারা তাদের যুক্তির পক্ষে '৭৫-এর পরবর্তী ঘটনার উল্লেখ করেন। প্রকৃতপক্ষে ক্যু'দেতার পর যা ঘটলো তা হচ্ছে খন্দকার মোশতাক পুরোনো আওয়ামী লীগারদের নিয়ে সরকার গঠন করলেন। মুজিব বিরোধী অন্যান্য সংগঠনকে তিনি মন্ত্রিসভায় আমন্ত্রণ জানালেন না। মুজিবের ১৮ জন মন্ত্রীর মধ্যে তিনি ১০ জনকে বহাল রাখলেন। প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে মাত্র ১ জন মোশতাকের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়লো। পূর্ণ মন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র আবু সাঈদ চৌধুরী বাদে ৯ জনই বাকশালের নির্বাহী পরিষদ বা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
বাকশালের অত্যধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ১৫ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী পরিষদের ৫ জন মোশতাক মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। বাকি ১০ জনের মধ্যে ২ জন ক্যু'দেতায় মারা যান (শেখ মুজিব ও শেখ মনি)। ৭ জনকে জেলে পাঠানো হয়। এর মধ্যে সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী ও এইচ এম কামরুজ্জামান বন্দি অবস্থায় জেলে নিহত হন। বাকি ১ জন পালিয়ে রাশিয়া চলে যেতে সক্ষম হন।
মোশতাকের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ নেতাদের একক অন্তর্ভুক্তি 'প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের' ফল। এরা শেখ মুজিবের বাকশাল গঠন মেনে নিতে পারেননি। একটি তথ্যে জানা যায়, আওয়ামী নেতাদের একটি অংশ (যাদের মধ্যে ছিলেন ওবায়দুর রহমান, নুরে আলম সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম মঞ্জু, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন) বাকশাল গঠনের পর এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে বাকশাল বিরোধিতার সিদ্ধান্ত নেন। এই সূত্রের মতে, অভ্যুত্থানকারীদের সাথে এইসব নেতাদের যোগাযোগ ছিল। আওয়ামী লীগের সংসদীয় আমলের শেষের দিকে যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সেই মোহাম্মদ উল্লাহও স্বীকার করেছেন যে, মুজিবের মন্ত্রিসভায় অনেকে বাকশাল বিরোধী ছিলেন।
শেখ মুজিবের মন্ত্রীদের অন্যতম সদস্য ও বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'অভ্যুত্থানকারী মেজরদের অন্যতম মেজর ডালিম তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ও কামরুজ্জামানকে ক্ষমতা গ্রহণ করার আহবান জানিয়েছিলেন।' ব্যাপারটি যদি সত্যি হয়, তবে ভাবতে অবাক লাগে যে, সৈয়দ নজরুল ও কামরুজ্জামানের মতো ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা কেন শেখ মুজিবকে কথাটা খুলে বলেননি। এর সঠিক ব্যাখ্যা এখন আর পাওয়া সম্ভব নয়। কেননা এদের অধিকাংশ এখন বেঁচে নেই। অধ্যাপক ইউসুফ আলী মিথ্যা পরিবেশন করবেন এটা ভাবা না গেলেও ঘটনাটি অধিকাংশ মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। '৯১ জুলাই মাসে কর্নেল ফারুক বলেছেন, 'প্রয়োজনে তিনি হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দেবেন।' কর্নেল ফারুক কি আওযামী লীগ নেতাদের একটা অংশের সাথে তার পূর্ব যোগাযোগের ইঙ্গিত দিয়েছেন?"
- শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অজানা অধ্যায় / সম্পাদনা: শহিদুল ইসলাম মিন্টু ॥ [ শিখা প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭ । পৃ: ৩৯-৪০ ]
#১৩
"... এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ ও অমানিশার অবসান ঘটে বাংলা মায়ের সাতটি সন্তানের দু:সাহসিক প্রচেষ্টায়। মৃত্যুঘন্টা বাজে মুজিবী জালেমশাহীর। উদয় হয় অরুণ রাঙ্গা প্রভাত। অকুতোভয় এই সাতটি দামাল সন্তান যেন বাংলাদেশের সাত কোটি মুক্তিপাগল বাঙ্গালীর আশা-আকাঙ্খার সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। এক এক কোটির প্রতিনিধি যেন এক একজন। ইহারা হইতেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭ জন অফিসার লে: কর্নেল রশীদ, লে: ক: ফারুক, মেজর পাশা, মেজর হুদা, মেজর মহিউদ্দিন এবং পদচ্যুত মেজর ডালিম এবং মেজর শাহরিয়ার। সেইদিন যেমন আপামর বাঙ্গালী জনতা তাহাদিগকে কৃতজ্ঞতাভরে হৃদয় নিংড়ানো স্বত:স্ফূর্ত সমর্থন জানাইয়াছিল, তেমনি স্বাধীনতচেতা বাঙ্গালী মাত্রই চিরকাল এই ৭ জন তরুণকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাইবে। বস্তুত: জাতীয় নেতৃত্বের অবিমৃষ্যকারিতা ও বিজাতীয় দাসত্বের শৃঙ্খল হইতে মুক্তি পাওয়ার সূর্য সম্ভাবনা হিসাবেই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সত্যিই এক অনন্য দিবস। ইহা ছিল কার্যত: দিল্লী ও দিল্লির দাসত্বের অশুভ শৃঙ্খল মোচনের প্রথম পদক্ষেপ ও শুভ সূচনা॥"
- অলি আহাদ / জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে '৭৫ ॥ [বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি - অক্টোবর, ২০১২ (পঞ্চম সংস্করণ) । পৃ: ৪৮৮]
#১৪
"... আমি হারিয়ে গেছি বিশালতায়। মুগ্ধতায় ভেসে যাচ্ছি। আমার কাছে আনকোরা সব তথ্য। নিক্সনকে বাংলায় লেখা শেখ মুজিবের চিঠি, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ঘটনাবলিতে মুজিবের নিজের ও তাঁর প্রতি অন্যের মূল্যায়ন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের ও অভ্যুদয় পর্বের মূল চিঠিপত্র এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধরত বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠন নিয়ে কলকাতায় কিসিঞ্জার-মোশতাক-চাষি গ্রুপের গোপন তৎপরতা—আরও কত কী! ..... মুজিবের 'ভাগনে' প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডকে (১৯৭৪-১৯৭৭) চিঠি লিখেছেন। মামা মুজিব তাঁকে হত্যা করতে চান। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পূর্বক্ষণে লেখা এ-সংক্রান্ত চিঠিপত্র পেয়ে খুবই অবাক হলাম। ..... পেলাম আর্চার ব্লাডের লেখা অনেক বার্তা। সেখানে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নও আছে। কোনটা ফেলে কোনটা নেব।"
- মিজানুর রহমান খান / মার্কিন ন্যাশনাল আর্কাইভসে । [প্রথম আলো - নভেম্বর ৪, ২০১৩]
#১৫
"... অপরদিকে রুশ-ভারত চক্র নিশ্চেষ্ট বসে ছিল না। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এই চক্রটিও ১৫ আগষ্ট (১৯৭৫) শেখ মুজিবুর রহমান-এর পরিকল্পিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান চলাকালে তাকে হত্যা করে তার স্থলে যুবলীগ প্রধান শেখ ফজলুল হক মণিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার নীলনক্সা তৈরী করেছিল। তাদের এই পরিকল্পনার কথা মার্কিনী মহল পূর্বাহ্নেই জেনে যায়। সে কারণে তারা অতিসঙ্গোপনে শেখ মুজিব ও অন্যান্যের হত্যা পরিকল্পনা ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে বাস্তবায়িত করে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মুজিব সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে শেখ মুজিব কর্তৃক ১৯৭৪ সালে মন্ত্রিপরিষদ থেকে অপসারণের পর রুশ-ভারত মহলের নেতৃত্ব তাজউদ্দিনের স্থলে ছাত্রলীগ নেতা ও পরে যুবলীগ নেতা এবং শেখ মুজিবের আপন ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির উপর অর্পিত হয়॥"
- সিরাজুল হোসেন খান ( প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং শ্রমিক নেতা, সাবেক মন্ত্রী ) / উপমহাদেশের সামাজিক- রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত ॥ [ঝিনুক প্রকাশ - ফেব্রুয়ারী, ২০০২ । পৃ: ২০০-২০২]
http://www.crimebdnews24.com/archives/9782
No comments:
Post a Comment