বিদেশী বিনিয়োগের চেয়ে বেশি হচ্ছে অর্থ পাচার
দেশে বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, হংকংসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আয়োজন করা হয়েছে বেশকিছু রোড শোও। তাতে কয়েক বছর ধরে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ আনতে সমর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ। তবে বিনিয়োগ যে হারে আসছে, তার চেয়ে বেশি হারে অর্থ পাচার হচ্ছে
দেশ থেকে।
গত এক দশকে এফডিআইয়ের দেড় গুণের বেশি অর্থ পাচার হয়েছে দেশ থেকে। আর স্বাধীনতার পর থেকে হিসাব করলে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ এফডিআইয়ের তিন গুণ।
সম্প্রতি সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত এক পর্যটন মেলায় মালয়েশিয়া সেকেন্ড হোম প্রকল্পের ফরম বিক্রি করা হয়। এর আগে হোটেল ওয়েস্টিনে দুবাইভিত্তিক দামাক প্রপার্টিজ তাদের আবাসন প্রকল্প নিয়ে মেলার আয়োজন করে। এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এজেন্টদের মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থ পাচারের ব্যবস্থা করছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, হংকং, দুবাই, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে এ অর্থ।
মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম সুবিধা নেয়ার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এক দশকে প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশী এ সুযোগ নিয়েছে। এছাড়া ব্যাংককের প্রপার্টি মার্কেটের বড় ক্রেতাও বাংলাদেশীরা। এর মাধ্যমে দেশ থেকে চলে গেছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দেশে এফডিআই এসেছে ৮২৪ কোটি ডলার। আর ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) হিসাবে ওই সময়ে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ৩১৬ কোটি ডলার। অর্থাত্ দেশে আসা এফডিআইয়ের তুলনায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৬০ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখ্ত বণিক বার্তাকে বলেন, পুঁজি পাচারের ক্ষেত্রগুলো শনাক্ত হওয়াটা খুবই জরুরি। বৈধ উপায়ে দেশের বাইরে অর্থ নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সীমারেখা তৈরি করা আছে। সেসব পন্থায় দেশের বাইরে অর্থ নিয়ে যাওয়ার পথ খুব বেশি নয়। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ নিয়ম মেনেই তাদের উপার্জিত অর্থ দেশের বাইরে নিয়ে যায়। এছাড়া ক্যাপিটাল আউটফ্লোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। তাই অবৈধ পন্থাগুলো কী, সেগুলো শনাক্ত করে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার আরো সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন।
এদিকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। সে হিসাবে চার দশকে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে স্বাধীনতার পর চার দশকে দেশে মোট এফডিআই এসেছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা।
বিনিয়োগ বোর্ড (বিওআই) বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে কাজ করলেও দেশের বাইরে অর্থ পাচার রোধে তেমন ভূমিকা নেই সংস্থাটির। এ প্রসঙ্গে বিওআইয়ের নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র মণ্ডল বলেন, অবৈধ উপায়ে অর্থ দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ঘটনা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই আছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থ পাচারের ঘটনা লোকমুখে শোনা গেলেও এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য এ বিষয়ে কেউ দিতে পারেনি। তাই প্রথমেই সুনির্দিষ্টভাবে এ বিষয়গুলো শনাক্ত করতে হবে। তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জিএফআইয়ের 'ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ: ২০০৩-১২' শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, অস্বচ্ছ ব্যবসায়িক লেনদেন বা মিস ইনভয়েসিং, দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে এ অর্থ স্থানান্তর করা হয়। আলোচ্য এক দশকে ব্যালান্স অব পেমেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫১০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মিস ইনভয়েসিং বা অস্বচ্ছ লেনদেনের মাধ্যমে পাচার হয়েছে ৮০৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। মূলত রফতানির ক্ষেত্রে এ মিস ইনভয়েসিং হয়। এর মধ্যে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার হয়েছে ১৪৬ কোটি ২০ লাখ ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ৬৮৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে বলে সম্প্রতি এক জরিপে উঠে এসেছে। এবার পাওয়া গেল অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার চিত্র। এ দুটি আসলে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া সম্প্রতি আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারিও বেড়েছে। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা লোকজনই সাধারণত দুর্নীতি, আর্থিক কেলেঙ্কারি ইত্যাদিতে জড়িত থাকে। নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নির্বাচনের আগে এগুলো সরিয়ে নেয়া হয়, যার চিত্র জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ২০১৩ সালের তথ্য পাওয়া গেলে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ আরো বেশি হবে বলেই মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে দেশে বিদেশী বিনিয়োগপ্রবাহ ছিল ৩৫ কোটি ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার। আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য বলছে, একই সময়ে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থপ্রবাহ ছিল ৮৩ কোটি ডলার। এর পর নিয়মিতই অর্থ পাচার বাড়তে থাকে। এর পাঁচ বছর পর ২০০৮-এ বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহ ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে যায়। যদিও এর দুই বছর আগে ২০০৫ সালে বাইরে যাওয়া অর্থপ্রবাহ ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।
আর ২০০৬ সালেই অবৈধ পাচার ২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে, সে বছর অর্থ বেরিয়ে যাওয়ার পরিমাণ ছিল ২৬৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০৭ সালে বেরিয়ে যাওয়া অর্থপ্রবাহ কমলেও এর পরিমাণ ছিল ২৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০০৮ সালে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাচার হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আশঙ্কা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারই এর মূল কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অর্থ পাচার কমে আসে। ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পাচার ও প্রবেশে অনেক উত্থান-পতন ঘটলেও ২০১২ সালে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ২০১২ সালে বেরিয়ে গেছে ১৭৮ কোটি ডলার। নির্বাচন সামনে রেখে এ বৃদ্ধি বলে মনে করা হয়। একই সময়ে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে ১২৯ কোটি ২৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
http://www.bonikbarta.com/2015-05-30/news/details/38387.html
No comments:
Post a Comment