অমিয়রঞ্জন বিশ্বাস
সঞ্চয়িতার কথা মনে আছে? ভুঁইফোঁড় সঞ্চয়িতা৷ একটু যাঁদের বয়স হয়েছে, তাঁরা নিশ্চয় ভোলেননি৷ নবীনদের কাছে একটু পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে নিই৷ বুড়ো হয়েছি৷ তাই একটা উপদেশও দিয়ে ফেলি, জীবনে এ জাতীয় সংস্থায় টাকা রাখবেন না৷ বেশি সুদের লোভ দেখালেও না৷ শেষমেশ সুদ তো দূরের কথা, আসল ফেরত পেতেই কয়েকশো মাইল হাঁটতে হবে৷ যেমন আমি হাঁটছি৷ আগে খুব জোরে হাঁটতাম৷ এখন লাঠি নিয়ে হাঁটি৷ কবে থেকে হাঁটছি মনেও নেই৷ পুরোনো কথা আজকাল আর তেমন মনে থাকে না৷ মাঝে মাঝে ভুলে যাই৷
তবে অনেক কিছুই ভুলিনি৷ কষ্টের রোজগার তো, তাই বারবার ঘা মারে৷ কাজ করতাম বেসরকারি সংস্থায়৷ হাজার দেড়েক টাকা মাইনে পেতাম৷ বাড়িতে বাবা-মা, স্ত্রী ও এক মেয়ে৷ আমিই একমাত্র রোজগেরে৷ টাকার দরকার ছিল৷ তবে টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরিনি৷ কারণ, আমার লোভ ছিল না৷ সেটা '৮০ সাল৷ আমারই এক সহকর্মী সঞ্চয়িতার এজেন্ট ছিলেন৷ আমার যাতে আরও টাকা হয়, তার জন্য ওঁর খুব দুশ্চিন্তা ছিল৷ আমাকে নানা ফন্দি-ফিকিরের কথা বলতেন৷ সঞ্চয়িতায় টাকা রাখলে নাকি আমার সংসারের হাল ফিরবে৷ প্রথম দিকে কানে তুলতাম না৷ কিন্তু সহকর্মী রোজই আমাকে তাগাদা মারতেন৷ শেষমেশ রাজিই হয়ে গেলাম৷ কতকটা তাড়নায়, কতকটা আশায়৷ দেখাই যাক না৷ যদি কিছু টাকা জমাতে পারি৷ পাঁচ হাজার টাকা জমা করলাম৷ মাসে ৩ শতাংশ সুদ৷ তখন পাঁচ হাজার টাকা নেহাত কম নয়৷ ওটাই ছিল আমার সঞ্চয়৷
এক বছরও কাটল না৷ মাথায় বাজ৷ খবরের কাগজে দেখলাম, সঞ্চয়িতার ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে৷ চোখে আঁধার৷ কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না৷ তখন এত ফোন নেই৷ কাকে কী বলব? আসল কথাটা জানবই বা কী করে? কয়েকজন চেনা আমানতকারী ছিলেন৷ আমারই মতো৷ তাঁদের বাড়িতে ছুটলাম৷ সবারই একই হাল৷ সর্বনাশ হয়েছে৷ দল বেঁধে ছুটলাম সঞ্চয়িতার অফিসে৷ সেখানে গিয়ে বুঝলাম, এত দিনের জমানো টাকা জলে গিয়েছে৷ মেয়েটা ছোট৷ ওর লেখাপড়ার খরচ আছে৷ বাবা-মা তখনও বেঁচে৷ দিশাহার অবস্থা৷ চাকরিও করতে হবে৷ আবার এ-সবও সামলাতে হবে৷ খুব গ্লানিবোধ হল৷ কেন যে টাকা রেখেছিলাম!
তবে আশা ছাড়িনি৷ টাকা ফেরত পেতেই হবে৷ কষ্টের টাকা৷ ধর্মতলায় বিক্ষোভ করলাম৷ আইন অমান্যেও যোগ দিলাম৷ কিন্তু টাকা ফেরত পাওয়ার আশা দিনকে দিন ক্ষীণ হয়ে এল৷ সেই সহকর্মীও মুখ ফিরিয়ে নিল৷ যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিল৷ এই এজেন্টরাই যত নষ্টের গোড়া৷ সারদা-কাণ্ডে দেখছি, অনেক এজেন্টও বিক্ষোভ করছেন৷ সঞ্চয়িতায় তেমন কিছু হয়নি৷ যত দায় আমানতকারীদের৷ মিটিং-মিছিলে কাজ হবে না বুঝে আমানতকারীরা দলবদ্ধ হয়ে মামলা করলেন৷ প্রথমে হাইকোর্ট৷ পরে সুপ্রিম কোর্ট৷ মামলা চালানোর চাঁদাও দিয়েছি৷ সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল, সঞ্চয়িতার সম্পত্তি বেচে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে৷ রায় শুনে খুব খুশি৷ এ বার তা হলে টাকা ফেরত পাব৷ একটি কমিশন তৈরি হল৷ কমিশনই খোঁজখবর নিয়ে টাকা ফেরত দেবে৷ সুদ দরকার নেই৷ আসল পেলেই হল৷ কিন্তু সে গুড়ে বালি৷ বছরের পর বছর কাটে৷ মেয়ে বড় হয়েছে৷ বাবা-মাও গত হয়েছেন৷ চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছে৷ মাইনেও বাড়ল৷ আস্তে আস্তে পাঁচ হাজার টাকার মূল্য অনেক কমে গেল৷ পাঁচ হাজার টাকা একবারেও পেলেও বিরাট কিছু হবে না৷ কিন্তু ওই যে বলে, ৮ ঘণ্টার খাটনির টাকা৷ তার স্বাদই আলাদা৷
বছর কয়েক আগে কমিশন থেকে চিঠি এল আমার বাড়ির ঠিকানায়৷ ৬২/১ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র অ্যাভিনিউ, দমদম৷ চিঠিতে লেখা কমিশনের অফিসে এসে টাকা নিয়ে যান৷ ভাবলাম, দেরিতেও হলেও টাকাটা পাব তো৷ স্ত্রীকে নিয়ে ব্যাঙ্কশাল কোর্ট চত্বরে কমিশনের অফিসে গেলাম৷ একটি চেকও মিলল৷ ৭৫০ টাকার৷ খারাপ লাগল না৷ ভালও লাগল না৷ এত কাণ্ডের পর মাত্র সাড়ে সাতশো! কী আর করা৷ বাড়ি ফিরে গেলাম৷ বছর খানেক বাদে আবার কমিশনের চিঠি৷ আপনার চেক নিয়ে যান৷ গেলাম৷ এ বার পেলাম ২৫০ টাকা৷ মানে দু'বার মিলিয়ে হাজার টাকা৷ বাকি রইল আরও চার হাজার৷ তৃতীয় চিঠি পেয়ে যখন কমিশনে যাই, তখনও মিলল সেই ২৫০ টাকা৷ '৮০ সালে ৫ হাজার টাকা রেখে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আমার প্রাপ্তি ১,২৫০ টাকা৷ ইতিমধ্যে আমার মেয়ের বিয়েও হয়েছে৷ সে মুম্বইয়ে সুখেই আছে৷ মেয়ে জানে না, আমরা এখনও টাকা নিতে আসি৷ জানলে খুব রাগ করবে৷ আগেই বলেছি, হাঁটতে কষ্ট হয়৷ সঙ্গে স্ত্রীও আসেন৷ দমদম থেকে যাতায়াতের খরচই আড়াইশোর টাকার বেশি লাগে৷ তবু কষ্টের টাকা তো! কমিশনের অফিসে দেখি, অনেক আমানতকারীর ছেলে এসেছে টাকা নিতে৷ কারণ, বাবা গত হয়েছেন৷ আমরাই বা আর কত দিন!
এখন দেখি মিডিয়া খুবই সক্রিয়৷ তখন এ-সব কিছুই ছিল না৷ টিভিতে যন্ত্রণাকাতর মুখগুলো দেখি৷ খুব কষ্ট হয়৷ এখন হয়তো পাঁচ হাজার টাকায় হাতিঘোড়া কিছু হবে না৷ কিন্তু তখন হত৷ আমার মেয়ে ছোট ছিল, আমার বাবা-মা বেঁচে ছিলেন৷ অনেক আশা ছিল৷ অনেক৷
(অমিয়রঞ্জন বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলেছেন ঝিলম করঞ্জাই)
সঞ্চয়িতার কথা মনে আছে? ভুঁইফোঁড় সঞ্চয়িতা৷ একটু যাঁদের বয়স হয়েছে, তাঁরা নিশ্চয় ভোলেননি৷ নবীনদের কাছে একটু পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে নিই৷ বুড়ো হয়েছি৷ তাই একটা উপদেশও দিয়ে ফেলি, জীবনে এ জাতীয় সংস্থায় টাকা রাখবেন না৷ বেশি সুদের লোভ দেখালেও না৷ শেষমেশ সুদ তো দূরের কথা, আসল ফেরত পেতেই কয়েকশো মাইল হাঁটতে হবে৷ যেমন আমি হাঁটছি৷ আগে খুব জোরে হাঁটতাম৷ এখন লাঠি নিয়ে হাঁটি৷ কবে থেকে হাঁটছি মনেও নেই৷ পুরোনো কথা আজকাল আর তেমন মনে থাকে না৷ মাঝে মাঝে ভুলে যাই৷
তবে অনেক কিছুই ভুলিনি৷ কষ্টের রোজগার তো, তাই বারবার ঘা মারে৷ কাজ করতাম বেসরকারি সংস্থায়৷ হাজার দেড়েক টাকা মাইনে পেতাম৷ বাড়িতে বাবা-মা, স্ত্রী ও এক মেয়ে৷ আমিই একমাত্র রোজগেরে৷ টাকার দরকার ছিল৷ তবে টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরিনি৷ কারণ, আমার লোভ ছিল না৷ সেটা '৮০ সাল৷ আমারই এক সহকর্মী সঞ্চয়িতার এজেন্ট ছিলেন৷ আমার যাতে আরও টাকা হয়, তার জন্য ওঁর খুব দুশ্চিন্তা ছিল৷ আমাকে নানা ফন্দি-ফিকিরের কথা বলতেন৷ সঞ্চয়িতায় টাকা রাখলে নাকি আমার সংসারের হাল ফিরবে৷ প্রথম দিকে কানে তুলতাম না৷ কিন্তু সহকর্মী রোজই আমাকে তাগাদা মারতেন৷ শেষমেশ রাজিই হয়ে গেলাম৷ কতকটা তাড়নায়, কতকটা আশায়৷ দেখাই যাক না৷ যদি কিছু টাকা জমাতে পারি৷ পাঁচ হাজার টাকা জমা করলাম৷ মাসে ৩ শতাংশ সুদ৷ তখন পাঁচ হাজার টাকা নেহাত কম নয়৷ ওটাই ছিল আমার সঞ্চয়৷
এক বছরও কাটল না৷ মাথায় বাজ৷ খবরের কাগজে দেখলাম, সঞ্চয়িতার ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে৷ চোখে আঁধার৷ কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না৷ তখন এত ফোন নেই৷ কাকে কী বলব? আসল কথাটা জানবই বা কী করে? কয়েকজন চেনা আমানতকারী ছিলেন৷ আমারই মতো৷ তাঁদের বাড়িতে ছুটলাম৷ সবারই একই হাল৷ সর্বনাশ হয়েছে৷ দল বেঁধে ছুটলাম সঞ্চয়িতার অফিসে৷ সেখানে গিয়ে বুঝলাম, এত দিনের জমানো টাকা জলে গিয়েছে৷ মেয়েটা ছোট৷ ওর লেখাপড়ার খরচ আছে৷ বাবা-মা তখনও বেঁচে৷ দিশাহার অবস্থা৷ চাকরিও করতে হবে৷ আবার এ-সবও সামলাতে হবে৷ খুব গ্লানিবোধ হল৷ কেন যে টাকা রেখেছিলাম!
তবে আশা ছাড়িনি৷ টাকা ফেরত পেতেই হবে৷ কষ্টের টাকা৷ ধর্মতলায় বিক্ষোভ করলাম৷ আইন অমান্যেও যোগ দিলাম৷ কিন্তু টাকা ফেরত পাওয়ার আশা দিনকে দিন ক্ষীণ হয়ে এল৷ সেই সহকর্মীও মুখ ফিরিয়ে নিল৷ যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিল৷ এই এজেন্টরাই যত নষ্টের গোড়া৷ সারদা-কাণ্ডে দেখছি, অনেক এজেন্টও বিক্ষোভ করছেন৷ সঞ্চয়িতায় তেমন কিছু হয়নি৷ যত দায় আমানতকারীদের৷ মিটিং-মিছিলে কাজ হবে না বুঝে আমানতকারীরা দলবদ্ধ হয়ে মামলা করলেন৷ প্রথমে হাইকোর্ট৷ পরে সুপ্রিম কোর্ট৷ মামলা চালানোর চাঁদাও দিয়েছি৷ সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল, সঞ্চয়িতার সম্পত্তি বেচে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে৷ রায় শুনে খুব খুশি৷ এ বার তা হলে টাকা ফেরত পাব৷ একটি কমিশন তৈরি হল৷ কমিশনই খোঁজখবর নিয়ে টাকা ফেরত দেবে৷ সুদ দরকার নেই৷ আসল পেলেই হল৷ কিন্তু সে গুড়ে বালি৷ বছরের পর বছর কাটে৷ মেয়ে বড় হয়েছে৷ বাবা-মাও গত হয়েছেন৷ চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছে৷ মাইনেও বাড়ল৷ আস্তে আস্তে পাঁচ হাজার টাকার মূল্য অনেক কমে গেল৷ পাঁচ হাজার টাকা একবারেও পেলেও বিরাট কিছু হবে না৷ কিন্তু ওই যে বলে, ৮ ঘণ্টার খাটনির টাকা৷ তার স্বাদই আলাদা৷
বছর কয়েক আগে কমিশন থেকে চিঠি এল আমার বাড়ির ঠিকানায়৷ ৬২/১ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র অ্যাভিনিউ, দমদম৷ চিঠিতে লেখা কমিশনের অফিসে এসে টাকা নিয়ে যান৷ ভাবলাম, দেরিতেও হলেও টাকাটা পাব তো৷ স্ত্রীকে নিয়ে ব্যাঙ্কশাল কোর্ট চত্বরে কমিশনের অফিসে গেলাম৷ একটি চেকও মিলল৷ ৭৫০ টাকার৷ খারাপ লাগল না৷ ভালও লাগল না৷ এত কাণ্ডের পর মাত্র সাড়ে সাতশো! কী আর করা৷ বাড়ি ফিরে গেলাম৷ বছর খানেক বাদে আবার কমিশনের চিঠি৷ আপনার চেক নিয়ে যান৷ গেলাম৷ এ বার পেলাম ২৫০ টাকা৷ মানে দু'বার মিলিয়ে হাজার টাকা৷ বাকি রইল আরও চার হাজার৷ তৃতীয় চিঠি পেয়ে যখন কমিশনে যাই, তখনও মিলল সেই ২৫০ টাকা৷ '৮০ সালে ৫ হাজার টাকা রেখে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আমার প্রাপ্তি ১,২৫০ টাকা৷ ইতিমধ্যে আমার মেয়ের বিয়েও হয়েছে৷ সে মুম্বইয়ে সুখেই আছে৷ মেয়ে জানে না, আমরা এখনও টাকা নিতে আসি৷ জানলে খুব রাগ করবে৷ আগেই বলেছি, হাঁটতে কষ্ট হয়৷ সঙ্গে স্ত্রীও আসেন৷ দমদম থেকে যাতায়াতের খরচই আড়াইশোর টাকার বেশি লাগে৷ তবু কষ্টের টাকা তো! কমিশনের অফিসে দেখি, অনেক আমানতকারীর ছেলে এসেছে টাকা নিতে৷ কারণ, বাবা গত হয়েছেন৷ আমরাই বা আর কত দিন!
এখন দেখি মিডিয়া খুবই সক্রিয়৷ তখন এ-সব কিছুই ছিল না৷ টিভিতে যন্ত্রণাকাতর মুখগুলো দেখি৷ খুব কষ্ট হয়৷ এখন হয়তো পাঁচ হাজার টাকায় হাতিঘোড়া কিছু হবে না৷ কিন্তু তখন হত৷ আমার মেয়ে ছোট ছিল, আমার বাবা-মা বেঁচে ছিলেন৷ অনেক আশা ছিল৷ অনেক৷
(অমিয়রঞ্জন বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলেছেন ঝিলম করঞ্জাই)
No comments:
Post a Comment