বোল্ডার দিয়ে থেতলে খুন সোমিনা-আমিনাকে
নিজস্ব সংবাদদাতা
মেদিনীপুর, ২৭শে মার্চ— শত অত্যাচারেও সি পি আই (এম)-র প্রতি সমর্থন ত্যাগ করতে পারেননি বলেই ঝাড়গ্রামের মানিকপাড়ার খেতমজুর সংখ্যালঘু পরিবারের দুই মহিলাকে নৃশংসভাবে খুন হতে হলো তৃণমূল-মাওবাদীদের হামলায়। চারদিন নিখোঁজ থাকার পর মুড়াবনি এবং শালপাতরা গ্রামের দুই মহিলা সোমিনা বিবি এবং আমিনা বিবির ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ শনিবার সকালেই উদ্ধার হয়েছে রামারামার জঙ্গল সংলগ্ন একটি শুকনো খাল থেকে। তৃণমূল-মাওবাদীদের এই বর্বরতার পর ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই ঝাড়গ্রাম মহকুমারই সাঁকরাইলে সেই একই কায়দায় বাড়ি থেকে তিনজন প্রৌঢ়া মহিলাসহ চারজনকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে অত্যাচার চালালো সেই তৃণমূল-মাওবাদী জল্লাদবাহিনীর বীরপুঙ্গবরা। এই ঘটনার বিরুদ্ধে নতুন করে জঙ্গলমহলের মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। প্রতিবাদী মানুষের মিছিল সংগঠিত হয়েছে সাঁকরাইল, শালবনীসহ জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকায়।
ঝাড়গ্রাম গ্রামীণ এলাকার মানিকপাড়া অঞ্চলের পাশাপাশি গ্রাম মুড়াবনি এবং শালপাতরা, ইন্দ্রাবনী, আখরাশোল গ্রামগুলির লাগোয়া। মুড়াবনি এবং শালপাতরা পাশাপাশি দুটি গ্রামের সংখ্যালঘু খেতমজুর পরিবারের মহিলা মোমিনা বিবি এবং আমিনা বিবি বরাবরই সি পি আই (এম)-র সমর্থক। শুধু এঁরাই নন, এলাকার মোট ৫৯টি পরিবারের সদস্যরাই পার্টি সমর্থক। এরমধ্যে ৩৬টি পরিবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তৃণমূলীদের সাহায্যে এই এলাকায় মাওবাদীরা জনসাধারণের কমিটি গঠন করেছিল মানুষকে অস্ত্রের মুখে দাঁড় করিয়ে। জনসাধারণের কমিটি গঠন করে তৃণমূলী-মাওবাদীরা এলাকাবাসীদের উপর লাগাতার অত্যাচার চালিয়ে যেতে থাকে। ঘরদোর ভাঙচুর, লুট, জরিমানা অহরহ ঘটতেই থাকে এলাকায়। দেড় বছর আগে প্রাণভয়ে এই ৩৬টি সংখ্যালঘু পরিবারসহ ৫৯টি পরিবারই ঘরছাড়া হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বাধ্য হন। শত অত্যাচারিত হয়ে ঘর ছাড়তে হলেও, মুড়াবনি, শালপাতরা মৌজার বাসিন্দারা লালঝাণ্ডার প্রতি সমর্থন ছাড়েননি। তারই পরিণতি মোমিনা বিবি এবং আমিনা বিবির উপর বর্বর অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করা।
কয়েকদিন আগেই ঘরে ফিরেছিলেন এই দুই মহিলা। মোমিনা বিবির স্বামী শেখ মইনুদ্দিন কয়েক বছর আগে মারা যান। একমাত্র ছেলে রফিক ঝাড়গ্রাম শহরে এক প্যাথলজি সেন্টারের কর্মী। অন্যদিকে আমিনার স্বামী শেখ সোহরাব আলি। তিনি দিনমজুর। তিন ছেলে পাঁশকুড়ায় কাজ করেন। কোনরকমে সংসার চলে এই দুই গরিব খেতমজুর পরিবারের। খড়ের চালসহ মাথা গোঁজার জন্য মাটির ঘর—সম্বল এইটুকুই। মঙ্গলবার তাঁদের বাড়ি থেকে মাওবাদী-তৃণমূলী জল্লাদবাহিনী তুলে নিয়ে যায় মোমিনা এবং আমিনা বিবিকে। আখরাশোল গ্রামের খগেন মাহাতো, মুড়াবনির মুচিরাম গিরি, জয়পুরের যোগেন দাস অধিকারীদের নেতৃত্বেই সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা এই দুই মহিলাকে 'চরম শাস্তি' দিতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরা এলাকায় একাধারে তৃণমূলের কর্মী, অন্যদিকে জনসাধারণের কমিটির নেতা। মাওবাদী নেতাদের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এককথায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় এরাই সর্বেসর্বা, এদের কথাই শেষ কথা।
মোমিনা এবং আমিনা বিবিকে তুলে নিয়ে গিয়ে এই জল্লাদরা চারদিন ধরে তাঁদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে পিটিয়ে ও বোল্ডার দিয়ে মাথা থেঁতলিয়ে খুন করে রামারামার জঙ্গলে লালবাঁধের খালে ফেলে দিয়ে যায়। শনিবার সকালে মৃতদেহ দু'টি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠায় পুলিস। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্তের পর মৃতদেহ দু'টিকে তাঁদের নিজেদের গ্রামে সমাধিস্থ করেন শত শত গ্রামবাসী। চোখের জলে শেষ বিদায় জানান তাঁদের প্রতিবেশিরা। মুড়াবনি গ্রামের জাকির হোসেন চোখের জল মুছেই এদিন বলেন, আমাদের উপর এত অত্যাচার দীর্ঘদিন ঘরছাড়া থাকা সত্ত্বেও তৃণমূলীরা তো বটেই, কোনও বিদ্বজন, সুশীলসমাজ, বুদ্ধিজীবীর মুখে রা নেই। আর মাওবাদীদের মৃত্যু হলে এদের কান্না থামানো যায় না। আতঙ্কে শেখ রসিদ আলি, শেখ হারুণরা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পরিবার-পরিজন নিয়ে নতুন করে এদিন ফের ঘর ছাড়েন।
মানিকপাড়ার ঘটনার একদিন না পেরোতেই ফের মাওবাদী-তৃণমূলী বর্বরতা প্রকাশ্যে এলো। এক্ষেত্রেও ঘটনাস্থল ঝাড়গ্রাম মহকুমায়। সাঁকরাইল ব্লকের রগড়া অঞ্চলের তিনজন মহিলাসহ চারজনকে তুলে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পেটালো মাওবাদী-তৃণমূলীরা। প্রাণ নিয়ে তারা জল্লাদদের কবল থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও, তৃণমূল-মাওবাদীরা এখনও প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে চলেছে।
জানা গেছে, রগড়ার হাড়পোড়িয়ায় সি পি আই (এম)-র শাখা সম্পাদক হরিপদ খিলাড়ির ছেলে দীপ্যমান খিলাড়ি (২৭)-কে কুড়াকপি থেকে অপহরণ করে এদিন সকালে নিয়ে যায় তৃণমূল-মাওবাদীরা। একইসঙ্গে জল্লাদরা চাঁদপাল গ্রামের তিন মহিলা, রত্নী সিংহ (৬০), পুঁট সিংহ (৫০) এবং নন্দিনী পাত্র (৭০)-কেও তুলে নিয়ে যায়। প্রত্যেকেই সি পি আই (এম)-র ঘনিষ্ঠ সমর্থক। সভরডাঙার জামশেদ আলি, শুভ্রাংশু আচার্য, তপন বেরা, পিন্টু দাস, প্রদীপ বেরা, সুনীল কিস্কু, মলয় দাস, রামচন্দ্র গিরিদের নেতৃত্বে একটি দল এঁদেরকে এদিন একে একে তুলে নিয়ে আসে কুড়াকপি গ্রামে। এদের মধ্যে রামচন্দ্র গিরি, জামশেদ আলি, প্রদীপ বেরাদের এলাকার মানুষ তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী হিসেবে চেনেন।
দীপ্যমান খিলাড়িকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীরা পুলিসকে জানানোর সাথে সাথে তৃণমূলনেতা সোমনাথ মহাপাত্রের কাছেও যান দীপ্যমানকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। প্রথমে তিনি অস্বীকার করলেও, পরে গ্রামবাসীদের চাপে এই তৃণমূলনেতা স্বীকার করতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, সি পি আই (এম) নেতার ছেলেকে ছেড়ে দিতে বলেছি। স্থানও বলে দেন ঐ তৃণমূল নেতা। সেইমতো নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে গ্রামবাসীরা দেখেন, দীপ্যমানকে ছাড়েনি দুর্বৃত্তরা। পরে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীদের চাপে দূরবর্তী একটি স্থানে অর্ধমৃত অবস্থায় দীপ্যমান খিলাড়িকে উদ্ধার করেন গ্রামবাসীরা। তাঁর সারা শরীরে কালশিটে দাগ। অসংখ্য বেত্রাঘাতের চিহ্ন। রক্ত ঝরছে শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে। কোনোমতে দীপ্যমান বলেন আরও দুই গরিব তফসিলী জাতির মহিলাকেও একইভাবে প্রচণ্ড মারধর করে ফেলে রেখেছে জল্লাদরা। গ্রামবাসীরা আশপাশের এলাকা থেকেই রত্নী সিংহ এবং পুঁট সিংহকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেন। এই দুই মহিলার কাছ থেকে গ্রামবাসীরা জানতে পারেন, আর একজন মহিলা নন্দিনী পাত্রকে মারধর করার সময় তিনি কোনোরকমে হাত ফসকে পালিয়ে যান।
এমন একটা দিনের জন্যেই এতো বছর ধরে লড়াই করেছেন বলাই এক্কা, দিলীপ লামারা। সেই লড়াই করেই পেলেন জঙ্গলে বসতের পাট্টা, চাষজমির পাট্টা। তবু, আজ মন ভালো নেই দিলীপ, বলাইদের। পরীক্ষায় পাস করেও, যেন ফেল করা ছাত্রের মতো করুণ মুখই দেখাচ্ছে ওদের। যন্ত্রণার কারণ, উপজাতি হওয়ায় এই পাট্টা তাঁরা পেলেন। কিন্ত বছরের পর বছর ধরে একসাথে যাঁদের সঙ্গে কাটলো জঙ্গলের জীবন, লড়াইও হলো একসাথে, আজ তাঁদের সেই সঙ্গী, পড়শীরা বনবাসী হলেও, উপজাতি না হওয়ায় পেলেন না সেই পাট্টা আইনি জটিলতায়। যা নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছে বামপন্থীরাই। আর যতটুকু অধিকার এসেছে তাও তো আন্দোলনের হাত ধরেই। অভিজ্ঞতাই তাদের দেখিয়ে দিচ্ছে অতীত আর বর্তমানের ফারাক
পুবে বয়ে যাচ্ছে সঙ্কোশ। পশ্চিমে রায়ডাক। মধ্যবর্তী এলাকাটি, যা বক্সা ব্যাঘ্রপ্রকল্পের কোর এরিয়ার মধ্যে পড়ে, সেখানেই রয়েছে এমন তিন বনবস্তি। কুমারগ্রাম বনবস্তি, সঙ্কোশ বনবস্তি, নিউ ল্যান্ডস বনবস্তি। কুমারগ্রাম বনবস্তিতে ১২৫ ঘর মানুষের বাস। পাট্টা পেয়েছে ৩২টি পরিবার। সঙ্কোশ বনবস্তিতে বাস করছে ৭০টি পরিবার। পাট্টা পেয়েছে ১৫টি পরিবার।। নিউ ল্যান্ডস বনবস্তিতে ৩৬টি পরিবারের বাস। পাট্টা পেয়েছে ৬টি পরিবার। মূলত উপজাতি না হওয়ার কারণে এবং কিছু আদিবাসী পরিবারের কাগজপত্র সংক্রান্ত সমস্যার জেরে এখনও বাকিদের মেলেনি সেই পাট্টা। সঙ্কোশ বনবস্তিতে মূলত ওঁরাও এবং নেপালীদেরই বাস। কুমারগ্রাম বনবস্তিতে নেপালীরাই রয়েছেন। উপজাতি এবং অনুপজাতি। আর বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের বাফার এরিয়াতেও রয়েছে এমন আরো বেশ কিছু বনবস্তি। ঘুট্টিমারি বনবস্তি, বালাপাড়া বনবস্তি কিংবা ইন্দুবনির মতো বনবস্তিগুলো। যেখানে সম্পূর্ণভাবেই উপজাতি পরিবারগুলির বাস, সেখানে এই সমস্যাটি হচ্ছে না। যেমন, চেংমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের ইন্দুবস্তি। এই বনবস্তিতে ৫৪ ঘর মানুষের বাস। রাভা, বোরো এবং ওঁরাও। তার মধ্যে ৪৮টি পরিবারই ইতোমধ্যে পেয়েছেন পাট্টা। হাতে গোনা যে'কটি পরিবার এখনো পায়নি, তারা পায়নি কাগজপত্রের সমস্যার কারণে। তবে তা যে বিশেষ সমস্যা হবে না, সে নিয়ে মোটের ওপর নিশ্চিত তারাও।
রাজ্য সরকারের তফসিলী জাতি, আদিবাসী এবং অন্যান্য অনগ্রসর কল্যাণ দপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এরাজ্যে বনাঞ্চলে পাট্টা পেয়েছেন ২৭ হাজার ৬৬৫ জন। এদের দেওয়া পাট্টা জমির পরিমাণ ১৫ হাজার ৮৩৬.১৭ একর। এছাড়াও আরো ২ হাজার ১৯২ জনের পাট্টা পাওয়ার প্রক্রিয়া প্রস্তুত রয়েছে। সেই জমির পরিমাণ ১ হাজার ৬৭৬.৮৫ একর। এর মধ্যে শুধু জলপাইগুড়ি জেলাতেই বন এলাকায় পাট্টা পেয়েছেন ৪ হাজার ৮৯৫ জন। তাদের পাট্টা পাওয়া জমির পরিমাণ ৭ হাজার ৫০০.৬৬ একর।
রাজ্যের তফসিলী আদিবাসীর হারের তুলনায়, এই জেলায় তফসিলী আদিবাসী মানুষের হারও অনেক বেশি। ২০০১ সালের জনগণনার তথ্য অনু্যায়ী, এরাজ্যে তফসিলী আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের হার ছিলো ৫.৫০ শতাংশ। আর জলপাইগুড়ি জেলাতে সেই হার ছিলো ১৮.৮৭ শতাংশ। যা ছিলো রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক।
খড়কাবাহাদুর বরাল, বীরবাহাদুর বরাল, অর্জুন বরাল, অঙ্কিত বরাল। চার প্রজন্ম কেটেছে এবং এখনও কাটছে সেই বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের কুমারগ্রাম বনবস্তিতেই। তবু, পাট্টা পাননি, অর্জুন বরালরা। যেমন পাননি কুমারগ্রাম বনবস্তিরই কুলবাহাদুর সঙ্গর, ধনবাহাদুর সঙ্গররাও। ঠিক যেমন সঙ্কোশ বনবস্তির বলাই এক্কা, অশোক এক্কা, জয়মসী লাকড়া, মানি লাকড়া, বেঞ্জামিন খাখারা পাট্টা পেলেও পাননি জয়বাহাদুর ছেত্রী, ভীমবাহাদুর ছেত্রী, বদ্রীনাথ ছেত্রী, অশোক প্রধানরা। অথচ, পাট্টা পাওয়া সঙ্কোশ বস্তির বলাই এক্কা যেমন বলেন, ঐ জয়বাহাদুর ছেত্রীরাই তো এই বনবস্তির প্রথম দিককার লোক, তেমনই কুমারগ্রাম বনবস্তির পাট্টা পাওয়া দিলীপ লামাও বলেন, 'আরে অর্জুন বরালের ঠাকুরদাকে তো আমরাই বছর পনেরো আগে দেখেছি এই কুমারগ্রাম বনবস্তিতেই মরতে।'
অধিকার দিয়েছে আইন। বাধ সেজেছেও আইন। রেকগ্নিশন অব ফরেস্ট রাইট্স অ্যাক্ট (২০০৬) অনুযায়ী, বনবাসীদের মধ্যে যাঁরা আদিবাসী, তাঁদের ক্ষেত্রে সমস্যা নেই। কিন্তু, যাঁরা আদিবাসী নন, তাঁদের এই পাট্টা পাওয়ার ক্ষেত্রে দাখিল করতে হবে, বিগত ৭৫ বছর ধরে বনে বসবাসের প্রমাণপত্র। কার্যত, সভ্যতার মূল স্রোত থেকে বহু দূরে রাখার জন্যই, বহু বছর পূর্বেই যাদের 'এগ্রিমেন্ট' করে এনে বসানো হয়েছিলো এই বনজঙ্গলগুলিতে, বাপ-ঠাকুরদা কিংবা তারও আগের কালের প্রমাণ, নথি সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং পেশ করা যে তাদের কাছে কার্যত অসম্ভব, তা মানছেন উপজাতি-অনুপজাতি নির্বিশেষে বনবস্তির মানুষেরাও। বামপন্থী আন্দোলনের কর্মী দিলীপ লামা জানালেন, এই সমস্যাটি উত্থাপন করা হয়েছে সম্প্রতি মালবাজারে অনুষ্ঠিত রাজ্য আদিবাসী কনভেনশনেও।
অথচ, বক্সাতেও যখন সি এফ সি প্রথা চালু ছিলো, তখন বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য গাছ কাটার পরে, সেই জমি পরিষ্কার করা, পুনরায় বিচুন গাড়ার কাজে ব্যবহারের জন্যই আনা হয়েছিলো এ সমস্ত পরিবারগুলিকে। জঙ্গলের অভ্যন্তরে কিছু জমি জায়গার বিনিময়ে বেগারই খাটানো হতো তাঁদের। দিলীপ লামা কিংবা বলাই এক্কা যেমন জানালেন, সে সময়ে কোনো আন্দোলনও ছিলো না। তাই এর প্রতিবাদও ছিলো না। কিন্তু বামপন্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলনের ফলেই ১৯৬৭ সালে আইন হয়, কাজের বিনিময়ে হাজিরা দেওয়া হবে। ক্রমে ক্রমে সেই আন্দোলন আরো জোরদার হওয়ার ফলেই, বনবস্তিতে ঘরদোর তৈরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পৌঁছেছে। এখন কুমারগ্রাম বনবস্তি কিংবা সঙ্কোশ, নিউ ল্যান্ড বনবস্তি কোর এরিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সি এফ সি-প্রথা বন্ধ। তাই সে কাজও মিলছে না। যদিও ইন্দুবস্তি, খুট্টিমারি বা বালাপাড়ার মতো বনবস্তিগুলি বাফার এরিয়ায় হওয়ায় এখনও সেখানে চালু আছে সি এস সি ব্যবস্থা।
আজ আজ ? সঙ্কোশ বনবস্তিই হোক বা কুমারগ্রাম কিংবা খুট্টিমারি বা ইন্দুবস্তি, প্রাথমিক স্কুল, উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুল কোথাও একেবারে দোরগোড়ায়, কোথাও সামান্য দূরে হলেও নাগালের মধ্যেই। কুমারগ্রামের এমন বারোটি বনবস্তির প্রায় আটশো পরিবারের এনিয়ে তেমন কোনো ক্ষোভই নেই। বরং নিজেদের অভিজ্ঞতাতেই তাঁরা বিচার করছেন অতীত আর বর্তমানের।
গ্রামবাসীরা এরপর দীপ্যমান খিলাড়ি, রত্নী সিংহ, পুঁট সিংহ, নন্দিনী পাত্রকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করেছেন। এই ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছেন রগড়াসহ সাঁকরাইল এলাকার মানুষ।
এমন একটা দিনের জন্যেই এতো বছর ধরে লড়াই করেছেন বলাই এক্কা, দিলীপ লামারা। সেই লড়াই করেই পেলেন জঙ্গলে বসতের পাট্টা, চাষজমির পাট্টা। তবু, আজ মন ভালো নেই দিলীপ, বলাইদের। পরীক্ষায় পাস করেও, যেন ফেল করা ছাত্রের মতো করুণ মুখই দেখাচ্ছে ওদের। যন্ত্রণার কারণ, উপজাতি হওয়ায় এই পাট্টা তাঁরা পেলেন। কিন্ত বছরের পর বছর ধরে একসাথে যাঁদের সঙ্গে কাটলো জঙ্গলের জীবন, লড়াইও হলো একসাথে, আজ তাঁদের সেই সঙ্গী, পড়শীরা বনবাসী হলেও, উপজাতি না হওয়ায় পেলেন না সেই পাট্টা আইনি জটিলতায়। যা নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছে বামপন্থীরাই। আর যতটুকু অধিকার এসেছে তাও তো আন্দোলনের হাত ধরেই। অভিজ্ঞতাই তাদের দেখিয়ে দিচ্ছে অতীত আর বর্তমানের ফারাক
পুবে বয়ে যাচ্ছে সঙ্কোশ। পশ্চিমে রায়ডাক। মধ্যবর্তী এলাকাটি, যা বক্সা ব্যাঘ্রপ্রকল্পের কোর এরিয়ার মধ্যে পড়ে, সেখানেই রয়েছে এমন তিন বনবস্তি। কুমারগ্রাম বনবস্তি, সঙ্কোশ বনবস্তি, নিউ ল্যান্ডস বনবস্তি। কুমারগ্রাম বনবস্তিতে ১২৫ ঘর মানুষের বাস। পাট্টা পেয়েছে ৩২টি পরিবার। সঙ্কোশ বনবস্তিতে বাস করছে ৭০টি পরিবার। পাট্টা পেয়েছে ১৫টি পরিবার।। নিউ ল্যান্ডস বনবস্তিতে ৩৬টি পরিবারের বাস। পাট্টা পেয়েছে ৬টি পরিবার। মূলত উপজাতি না হওয়ার কারণে এবং কিছু আদিবাসী পরিবারের কাগজপত্র সংক্রান্ত সমস্যার জেরে এখনও বাকিদের মেলেনি সেই পাট্টা। সঙ্কোশ বনবস্তিতে মূলত ওঁরাও এবং নেপালীদেরই বাস। কুমারগ্রাম বনবস্তিতে নেপালীরাই রয়েছেন। উপজাতি এবং অনুপজাতি। আর বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের বাফার এরিয়াতেও রয়েছে এমন আরো বেশ কিছু বনবস্তি। ঘুট্টিমারি বনবস্তি, বালাপাড়া বনবস্তি কিংবা ইন্দুবনির মতো বনবস্তিগুলো। যেখানে সম্পূর্ণভাবেই উপজাতি পরিবারগুলির বাস, সেখানে এই সমস্যাটি হচ্ছে না। যেমন, চেংমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের ইন্দুবস্তি। এই বনবস্তিতে ৫৪ ঘর মানুষের বাস। রাভা, বোরো এবং ওঁরাও। তার মধ্যে ৪৮টি পরিবারই ইতোমধ্যে পেয়েছেন পাট্টা। হাতে গোনা যে'কটি পরিবার এখনো পায়নি, তারা পায়নি কাগজপত্রের সমস্যার কারণে। তবে তা যে বিশেষ সমস্যা হবে না, সে নিয়ে মোটের ওপর নিশ্চিত তারাও।
রাজ্য সরকারের তফসিলী জাতি, আদিবাসী এবং অন্যান্য অনগ্রসর কল্যাণ দপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এরাজ্যে বনাঞ্চলে পাট্টা পেয়েছেন ২৭ হাজার ৬৬৫ জন। এদের দেওয়া পাট্টা জমির পরিমাণ ১৫ হাজার ৮৩৬.১৭ একর। এছাড়াও আরো ২ হাজার ১৯২ জনের পাট্টা পাওয়ার প্রক্রিয়া প্রস্তুত রয়েছে। সেই জমির পরিমাণ ১ হাজার ৬৭৬.৮৫ একর। এর মধ্যে শুধু জলপাইগুড়ি জেলাতেই বন এলাকায় পাট্টা পেয়েছেন ৪ হাজার ৮৯৫ জন। তাদের পাট্টা পাওয়া জমির পরিমাণ ৭ হাজার ৫০০.৬৬ একর।
রাজ্যের তফসিলী আদিবাসীর হারের তুলনায়, এই জেলায় তফসিলী আদিবাসী মানুষের হারও অনেক বেশি। ২০০১ সালের জনগণনার তথ্য অনু্যায়ী, এরাজ্যে তফসিলী আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের হার ছিলো ৫.৫০ শতাংশ। আর জলপাইগুড়ি জেলাতে সেই হার ছিলো ১৮.৮৭ শতাংশ। যা ছিলো রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক।
খড়কাবাহাদুর বরাল, বীরবাহাদুর বরাল, অর্জুন বরাল, অঙ্কিত বরাল। চার প্রজন্ম কেটেছে এবং এখনও কাটছে সেই বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের কুমারগ্রাম বনবস্তিতেই। তবু, পাট্টা পাননি, অর্জুন বরালরা। যেমন পাননি কুমারগ্রাম বনবস্তিরই কুলবাহাদুর সঙ্গর, ধনবাহাদুর সঙ্গররাও। ঠিক যেমন সঙ্কোশ বনবস্তির বলাই এক্কা, অশোক এক্কা, জয়মসী লাকড়া, মানি লাকড়া, বেঞ্জামিন খাখারা পাট্টা পেলেও পাননি জয়বাহাদুর ছেত্রী, ভীমবাহাদুর ছেত্রী, বদ্রীনাথ ছেত্রী, অশোক প্রধানরা। অথচ, পাট্টা পাওয়া সঙ্কোশ বস্তির বলাই এক্কা যেমন বলেন, ঐ জয়বাহাদুর ছেত্রীরাই তো এই বনবস্তির প্রথম দিককার লোক, তেমনই কুমারগ্রাম বনবস্তির পাট্টা পাওয়া দিলীপ লামাও বলেন, 'আরে অর্জুন বরালের ঠাকুরদাকে তো আমরাই বছর পনেরো আগে দেখেছি এই কুমারগ্রাম বনবস্তিতেই মরতে।'
অধিকার দিয়েছে আইন। বাধ সেজেছেও আইন। রেকগ্নিশন অব ফরেস্ট রাইট্স অ্যাক্ট (২০০৬) অনুযায়ী, বনবাসীদের মধ্যে যাঁরা আদিবাসী, তাঁদের ক্ষেত্রে সমস্যা নেই। কিন্তু, যাঁরা আদিবাসী নন, তাঁদের এই পাট্টা পাওয়ার ক্ষেত্রে দাখিল করতে হবে, বিগত ৭৫ বছর ধরে বনে বসবাসের প্রমাণপত্র। কার্যত, সভ্যতার মূল স্রোত থেকে বহু দূরে রাখার জন্যই, বহু বছর পূর্বেই যাদের 'এগ্রিমেন্ট' করে এনে বসানো হয়েছিলো এই বনজঙ্গলগুলিতে, বাপ-ঠাকুরদা কিংবা তারও আগের কালের প্রমাণ, নথি সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং পেশ করা যে তাদের কাছে কার্যত অসম্ভব, তা মানছেন উপজাতি-অনুপজাতি নির্বিশেষে বনবস্তির মানুষেরাও। বামপন্থী আন্দোলনের কর্মী দিলীপ লামা জানালেন, এই সমস্যাটি উত্থাপন করা হয়েছে সম্প্রতি মালবাজারে অনুষ্ঠিত রাজ্য আদিবাসী কনভেনশনেও।
অথচ, বক্সাতেও যখন সি এফ সি প্রথা চালু ছিলো, তখন বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য গাছ কাটার পরে, সেই জমি পরিষ্কার করা, পুনরায় বিচুন গাড়ার কাজে ব্যবহারের জন্যই আনা হয়েছিলো এ সমস্ত পরিবারগুলিকে। জঙ্গলের অভ্যন্তরে কিছু জমি জায়গার বিনিময়ে বেগারই খাটানো হতো তাঁদের। দিলীপ লামা কিংবা বলাই এক্কা যেমন জানালেন, সে সময়ে কোনো আন্দোলনও ছিলো না। তাই এর প্রতিবাদও ছিলো না। কিন্তু বামপন্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলনের ফলেই ১৯৬৭ সালে আইন হয়, কাজের বিনিময়ে হাজিরা দেওয়া হবে। ক্রমে ক্রমে সেই আন্দোলন আরো জোরদার হওয়ার ফলেই, বনবস্তিতে ঘরদোর তৈরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পৌঁছেছে। এখন কুমারগ্রাম বনবস্তি কিংবা সঙ্কোশ, নিউ ল্যান্ড বনবস্তি কোর এরিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সি এফ সি-প্রথা বন্ধ। তাই সে কাজও মিলছে না। যদিও ইন্দুবস্তি, খুট্টিমারি বা বালাপাড়ার মতো বনবস্তিগুলি বাফার এরিয়ায় হওয়ায় এখনও সেখানে চালু আছে সি এস সি ব্যবস্থা।
আজ আজ ? সঙ্কোশ বনবস্তিই হোক বা কুমারগ্রাম কিংবা খুট্টিমারি বা ইন্দুবস্তি, প্রাথমিক স্কুল, উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুল কোথাও একেবারে দোরগোড়ায়, কোথাও সামান্য দূরে হলেও নাগালের মধ্যেই। কুমারগ্রামের এমন বারোটি বনবস্তির প্রায় আটশো পরিবারের এনিয়ে তেমন কোনো ক্ষোভই নেই। বরং নিজেদের অভিজ্ঞতাতেই তাঁরা বিচার করছেন অতীত আর বর্তমানের।
বিক্ষোভ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও
আরব দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে যখন জনতার বিক্ষোভ আছড়ে পড়ছে, স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের গদি যখন বিপন্ন, ঠিক তখন সাম্রাজ্যবাদের আরেকটি নিষ্ঠুর খেলা আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তা হলো, পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি তেল থেকে যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব অর্জন করে, তার একটা বড় অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমী দেশগুলিতে চলে যায় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মারফত। জনতার বিক্ষোভের পিছনে এটাও একটা বড় কারণ বলে ধারণা। এত বিক্ষোভের মধ্যেও ঐসব দেশগুলিতে অস্ত্র বিক্রির জন্য শ'য়ে শ'য়ে কোটি ডলারের চুক্তির জন্য খুব চেষ্টা চালাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমী দেশগুলি। সোজা কথায় তারা তাদের অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের খুশি করার চেষ্টা করছে। মিশর, তিউনিসিয়া, বাহরিন এবং ইয়েমেন-এর শাসকশ্রেণীগুলি বিক্ষোভকারীদের উপরে দমন-পীড়ন চালানোর জন্য যেসব অস্ত্র, কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ব্যবহার করেছিল, সেগুলি সবই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির শাসকরা এইভাবে তেল থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে এতদিন আমেরিকা এবং পশ্চিমী দেশগুলি থেকে বিপুল পরিমাণে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র কিনেছে। এরজন্য তারা অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছে এবং পরিণতিতে দুর্বল হয়েছে দেশীয় অর্থনীতি। অপরদিকে, বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদান ও অধিকার থেকে সেখানকার সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়েছেন। তাই তাঁরা বিদ্রোহে ফুঁসে উঠেছেন। এর পিছনে যেমন রয়েছে ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশা-আকাঙ্ক্ষা, সেভাবে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা। তাঁরা উপলব্ধি করেছেন তাঁদের দেশের সম্পদ লুটেপুটে খাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি। মার্কিন-তাঁবেদার শাসকরা সাধারণ মানুষের কথা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে গিয়ে বিলাসব্যসনে সময় কাটিয়েছেন। তাই মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের উদগীরণ ঘটছে।
এত গণ্ডগোলের মধ্যেও ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তাঁর দেশের বৃহৎ অস্ত্র প্রস্তুতকারীদের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে উপসাগরীয় দেশগুলি সফর করেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য নিশ্চয় বিশদে ব্যাখ্যা করার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর মূল লক্ষ্য, উপসাগরীয় অঞ্চলের যেসব দেশে শেখ এবং আমীরদের আধিপত্য রয়েছে, সেখানে অস্ত্র বিক্রি করা। কারণ ঐ দেশগুলিতে বিপুল পরিমাণে পেট্রোডলার গচ্ছিত রয়েছে। ইরানকে জুজু হিসেবে দেখিয়ে ঐ দেশের প্রতিবেশী দেশগুলিতে ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০০০ কোটি ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে। ওবামা প্রশাসন মার্কিন কংগ্রেসকে জানিয়েছিল, ২০০৯ এবং ২০১০ সালে পশ্চিম এশিয়ায় ১০,০০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র রপ্তানির সম্ভাবনা আছে। মিশর ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২০০ কোটি ডলারের অস্ত্র কিনেছিল। ইজরায়েলের পর মিশর হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম মার্কিন অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে মিশর ১০৪০ কোটি ডলারের অস্ত্র কিনেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। তিউনিসিয়ায় সম্প্রতি উৎখাত হওয়া জিনে আল আবিদিন বেন আলি সরকার ২০০৯ সালে ১.৫ কোটি ডলারের অস্ত্র কিনেছিল। জর্ডনেও জনতার প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়েছে। ঐ দেশটি গতবছর আমেরিকার কাছ থেকে ৪৩.১ কোটি ডলারের সমরাস্ত্র আমদানি করেছে। বাহরিনে এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়া থেকে জনতার বিক্ষোভ চলছে। সেদেশের সরকার ২০১০ সালে আমেরিকার কাছ থেকে ১০ কোটি ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র কিনেছিল। এইসব অস্ত্র দিয়ে মানামায় পার্ল স্কোয়ারে বিক্ষোভকারীদের উপরে দমন-পীড়ন চালিয়েছিল বাহরিন সরকার। এখনও মার্কিন এবং পশ্চিমী দেশগুলি থেকে অস্ত্র কেনার তোড়জোড় চলছে। আরব দুনিয়ার মানুষের আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এই ধরনের তাঁবেদারির জন্য। তাদের দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমানে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করছে। আরব দুনিয়ার মানুষ এসব বরদাস্ত করছেন না বলেই বিক্ষোভ আরও ছড়িয়ে পড়ছে।
মনমোহনের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মোহালি ম্যাচে আসছেন গিলানি
সংবাদ সংস্থা
নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ, ২৭শে মার্চ — মোহালির ম্যাচকেই কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার হাতিয়ার করছে ভারত-পাকিস্তান। বুধবার ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সেমিফাইনালকে ঘিরে যেমন উত্তেজনার পারদ চড়ছে, তেমনি অন্যদিকে চলছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কাঠিন্য দূরে সরিয়ে রেখে বরফ গলানোর প্রয়াসও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ভঙ্গুর শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর উদ্যোগকেই কার্যত উসকে দিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি। ঐদিন মোহালিতে ম্যাচ দেখতে আসছেন গিলানি, ম্যাচের ফাঁকে সম্ভবত কথাও হবে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের। সেক্ষেত্রে মোহালি স্রেফ দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর ২২গজের লড়াই নয়, সাক্ষী হয়ে থাকবে রাজনৈতিক ইতিহাসের আর এক অধ্যায়েরও।
এমনিতে দু'দেশের খেলা মানেই মাঠে সেই চিরাচরিত স্নায়ুযুদ্ধ, দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার অদম্য জেদ। ক্রিকেট, হকি, ফুটবল থেকে খো খো—যে কোনো ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে এটাই দস্তুর। আবার একইভাবে এই লড়াইকে ঘিরে কখনও অদৃশ্য, কখনও বা প্রকাশ্যে চলে আসে রাজনীতি, দু'দেশের সম্পর্কের টানাপড়েনও। সেদিক থেকে মনমোহন সিংয়ের উদ্যোগ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। শান্তি প্রক্রিয়া চলছিল ভালোভাবেই, ছেদ ঘটে গেল ২০০৮-র নভেম্বরে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলায়। সেই প্রক্রিয়া ফের শুরুর তাগিদ থেকেই মনমোহন শুধু পাক প্রধানমন্ত্রী নন, ম্যাচ দেখার আমন্ত্রণ জানান পাক রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারিকেও। তবে জারদারি আসছেন না, আসছেন গিলানি। রবিবার পাকিস্তান প্রশাসন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মনমোহন সিংয়ের আমন্ত্রণ সম্পর্কে এদিন পাকিস্তান সরকারের তরফে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, 'সম্পর্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতা'। দু'দেশের কূটনৈতিক বিচ্ছেদ ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার পক্ষে এই উদ্যোগ এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বলেই মনে করছে ইসলামাবাদ। এদিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী গিলানিও বলেছেন, 'আমরা সবাই এই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আন্তরিক। আর আলোচনা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া এর কোনো বিকল্পও নেই।' বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুম্বাই হামলার পর যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল তা অনেকটাই পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে মোহালির ম্যাচে দুই রাষ্ট্রনেতার উপস্থিতি। তবে এই সফর থেকে বড় কিছু আশা করা উচিত হবে না। এমনও বলা হচ্ছে যে, দুই নেতার উদ্যোগ অন্ততপক্ষে উত্তেজনা প্রশমিত করার পাশাপাশি আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করবে। সেটাই অনেক প্রাপ্তি। এই কথা আরও আসছে কারণ, কয়েকদিন আগেই উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্যেই জানা গেছে যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রশ্নে মনমোহন সিং তাঁর মন্ত্রিসভায় একঘরে।
এদিকে, দু'দেশের মধ্যে ক্রিকেটকে ঘিরে কূটনীতির ঘটনা এই প্রথম হতে যাচ্ছে না। ১৯৮৭সালে তৎকালীন পাক রাষ্ট্রপতি জিয়া-উল-হক ভারত-পাকিস্তান একদিনের ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে ভারতে এসেছিলেন। তখনও উত্তেজনা ছিল সীমান্তে। ২০০৫সালে আর এক পাক রাষ্ট্রপতি তথা মিলিটারি শাসক পারভেজ মুশারফও ক্রিকেট খেলা দেখতে এসেছিলেন ভারতে। কিন্তু সেই সফর কার্যত শীর্ষ বৈঠকে রূপান্তরিত হয়ে যায়। দুই নেতাই দুই কাশ্মীরের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলার ব্যাপারে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেক গ্রহণ করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সদিচ্ছা দেখিয়েছেন পাক রাষ্ট্রপতি জারদারিও। তিনি এদিন গোপাল দাস নামের এক ভারতীয় নাগরিককে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। দীর্ঘ ২৭বছর ধরে গোপাল দাস বন্দী ছিলেন পাকিস্তানের জেলে। 'মানবিক কারণেই' তাঁকে মুক্তি দেওয়া হলো বলে এদিন পাকিস্তান প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। এও বলা হয়েছে, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আবেদনের ভিত্তিতেই পাকিস্তান সরকার সাড়া দিয়েছে। এরইসঙ্গে প্রাক্তন পাকিস্তান ক্রিকেটার জাভেদ মিঁয়াদাদ মনে করেন, মোহালিতে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখতে ক্রীড়াবিদ এবং শিল্পীদের ভারতে পাঠানো উচিত সরকারের। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেছেন, মোহালির ম্যাচকে দু'দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করা উচিত।
মোহালির ম্যাচের আগেই অবশ্য সোমবার থেকে নয়াদিল্লিতে শুরু হচ্ছে দু'দেশের স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী কামার জামান এদিন জানিয়েছেন, এই উদ্যোগ দু'দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রভূত সাহায্য করবে। দু'দিন ধরে আলোচনা চলবে। জামান ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল নিয়ে এসেছেন। ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন জি কে পিল্লাই।
চলতি সপ্তাহেইস্পেকট্রাম মামলায় চার্জশিট
দাখিল করতে পারে সি বি আই
সংবাদ সংস্থা
নয়াদিল্লি, ২৭শে মার্চ— ২জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি মামলায় প্রাক্তন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী এ রাজা এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করবে সি বি আই। এই সপ্তাহেই বহু চর্চিত পাহাড়-প্রমাণ আর্থিক দুর্নীতির এই মামলার প্রথম চার্জশিটটি বিশেষ আদালতে দাখিল হতে পারে বলেই সংবাদ সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে। বিশেষ আদালতের বিচারপতি ও পি সাইনির এজলাসে রাজার পরিচিত কয়েকজন আবাসন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেও চার্জশিট দাখিল করতে পারে সি বি আই। আদালতে এদের সকলের বিরুদ্ধেই অপরাধমূলক চক্রান্তের মাধ্যমে টেলিকম লাইসেন্স পাওয়ার অভিযোগ দায়ের করা হতে পারে। অবশ্য এই চার্জশিটে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ থাকবে না। সি বি আই সূত্র থেকে এই খবর জানানো হয়েছে। কারণ ২জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি মামলায় মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এপর্যন্ত নির্ধারণ করে উঠতে পারেনি টেলিকম অথরেটিটিভ অথরিটি অব ইন্ডিয়া (ট্রাই)।
ঘটনাচক্রে ২০০৭-০৮সালে রাজা প্রথম ইউ পি এ সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় টেলিকমমন্ত্রী থাকাকালীন ২জি স্পেকট্রাম লাইসেন্স বণ্টন করা হয়। আর কিছুদিন পরই তামিলনাডুতে বিধানসভা নির্বাচন। দক্ষিণের এই রাজ্যে কংগ্রেস এবং ডি এম কে'র মধ্যে জোট রয়েছে। ভোটের আগে সি বি আই'র চার্জশিট দাখিল তাই বিশেষভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত, গত বছর সুপ্রিম কোর্টে ২০১১সালের ৩১শে মার্চের আগে এই মামলার প্রথম চার্জশিটটি দাখিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো দেশের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
ওয়াকিবহাল মহলের অনুমান, সি বি আই চার্জশিট দাখিল করে এই মামলার তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আদালতে প্রয়োজনীয় অনুমতি চাইতে পারে। কারণ এই মামলার বিভিন্ন দিক ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখতে চায় সি বি আই। বিশেষত যে সমস্ত সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে বেনিয়ম করে ২জি স্পেকট্রাম লাইসেন্সের বরাত বণ্টন করার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এই মামলায় ইতোমধ্যেই প্রাক্তন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী রাজা, তাঁর ব্যক্তিগত সচিব আর কে চানডোলিয়া, প্রাক্তন টেলিকম সচিব সিদ্ধার্থ বেহুরা, এটিস্লাট ডি বি ( পূর্বে সাওয়ান টেলিকম) সংস্থার প্রাক্তন ডিরেক্টর শহীদ উসমান বালওয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি এই চার্জশিটে অন্য একজন সাংসদের নামও থাকতে পারে। এদের সকলের বিরুদ্ধেই ২জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৮সালের জানুয়ারি মাসে ২জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি ঘটনায় দেশের ২২হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে বলেই এর আগে সি বি আই'র পক্ষ থেকে আদালতে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিলো। যদিও সি এ জি ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করেছিলো ১লক্ষ ৭৬হাজার কোটি টাকা।
লিবিয়ায় নিরীহ মানুষের মৃত্যুর দায়
গদ্দাফির ওপরেই চাপালো আমেরিকা
সংবাদ সংস্থা
ওয়াশিংটন ও ত্রিপোলি, ২৭শে মার্চ— দেশে বিদেশে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে লিবিয়ায় মার্কিন মদতপুষ্ট ন্যাটোবাহিনীর বর্বরতার দায়ও গদ্দাফির উপরেই চাপানোর চেষ্টা শুরু করলো আমেরিকা। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট গেটস দাবি করেছেন, তাদের বিমান হানায় লিবিয়ার সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়নি, গদ্দাফির বাহিনী পরিকল্পিতভাবে মৃতদেহ এনে ফেলে রাখছে। দুনিয়ার সামনে মার্কিন সরকার এবং তাদের মদতপুষ্ট ন্যাটো বাহিনী সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করতেই এই কাজ গদ্দাফির বাহিনী করছে বলে দাবি করেছেন গেটস।
গেটসের দাবি, তারা নানাভাবে গোয়েন্দা রিপোর্ট জড়ো করেছেন। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে গদ্দাফির বাহিনী মানুষকে খুন করছে। তারপর যেখানে মার্কিন এবং ন্যাটোবাহিনী বিমান হামলা চালাচ্ছে সেখানে এনে ঐ মৃতদেহ ফেলে রাখছে। গেটসের দাবি অনুযায়ী, মার্কিন মদতপুষ্ট ন্যাটোবাহিনী নাকি সর্বাধিক সতর্কতার সঙ্গে আগ্রাসন চালাচ্ছে। গেটসের আরো দাবি, শুধু মার্কিন বোমারু বিমানের পাইলটরাই নন, ন্যাটোবাহিনীর অন্য দেশের বোমারু বিমানের পাইলটরাও নাকি এবিষয়ে অভাবনীয় কাজ করছে।
এদিকে, মার্কিন মদতপুষ্ট ন্যাটোবাহিনীর মদতে গদ্দাফির বিদ্রোহী বাহিনী পূর্ব লিবিয়ার তেল ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত রাস লানৌফ শহর রবিবার দখল করে নিয়েছে। বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি বেনঘাজি থেকে ৩৭০কিলোমিটার দূরে রাস লানৌফ শহর। কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই শহর দখলের পর বিদ্রোহীরা খুবই উৎসাহী। এদিন সকাল ন'টা নাগাদ মার্কিন মদতপুষ্ট ন্যাটো বাহিনী প্রথমে বিমান হামলা চালিয়ে গদ্দাফির বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে, তাদের ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে। তারপরেই সেই জায়গার দখল নেয় গদ্দাফির বিদ্রোহী বাহিনী। এই ঘটনায় আবারও প্রমাণ হলো যে, গদ্দাফির বিদ্রোহীদের মদত দিচ্ছে আমেরিকা আর সহযোগীরা।
৫লক্ষের ঢলে লন্ডন কাঁপলো প্রতিবাদের ঝড়ে
সংবাদ সংস্থা
লন্ডন, ২৭শে মার্চ— ট্রাফলগার স্কোয়ারে এবার তাহরির স্কোয়ারের মেজাজ।
কোথায় ব্রিটেন, কোথায় মিশর। কোথায় ক্যামেরন, কোথায় মুবারক। দুই আন্দোলনের দাবিও আলাদা। তবু লন্ডনের ট্রাফলগার স্কোয়ারে প্রতিবাদের মেজাজ যেন ছুঁয়ে গিয়েছে কায়রোর তাহরির স্কোয়ারকে।
সরকারের ব্যয়সঙ্কোচনের নীতির প্রতিবাদে, শনিবার লন্ডনে বিক্ষোভে শামিল হলেন ৫লক্ষাধিক মানুষ। জানাচ্ছে ব্রিটেনের প্রথমসারির সংবাদপত্র দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট। ২০০৩সালে ইরাক আগ্রাসনের পর গত আট বছরে এতো বিশাল প্রতিবাদ আন্দোলন আর কখনও স্বচক্ষে দেখেনি লন্ডনের মানুষ।
লন্ডনে গণ-বিস্ফোরণ!
শনিবার আনাবিল থমকে গিয়েছিলো ব্রিটেনের রাজধানীর হৃদস্পন্দ। শাফটাসেব্যারি অ্যাভেনিউ থেকে হাইড পার্ক। জেরমিন স্ট্রিট কিম্বা অক্সফোর্ড স্ট্রিট। সর্বত্রই প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের স্বেচ্ছাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। দলে দলে শামিল হয়েছিলেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ। অনেকের হাতে ছিলো রঙিন পোস্টার। মুখে ছিলো বিকল্পের এই অভিযানের পক্ষের স্লোগান। এদিন এই প্রতিবাদ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলো ব্রিটেনের ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (টি ইউ সি)। শুরুতে মনে করা হয়েছিলো প্রায় ১লক্ষ মানুষ লন্ডনের বুকে প্রতিবাদে অংশ নিতে পারেন। কিন্তু সেই অনুমান মেলেনি। ব্রিটেনেরই সংবাদপত্র গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, শুরুতেই দেশে কাজ ও মজুরি ছাঁটাইয়ের এই প্রতিবাদে লন্ডনে বিক্ষোভে শামিল হন ৪লক্ষের বেশি মেহনতী। পরে ৫লক্ষ প্রতিবাদী মানুষের জনজোয়ারে প্লাবিত হয় টেমস নগরী।
ব্রিটেনের কনজারভেটিভ এবং লিবারেল ডেমোক্র্যাট জোট সরকারের বেপরোয়া উদারীকরণের নীতির বিরুদ্ধে বিকল্পের আওয়াজ তোলেন আন্দোলনকারীরা। তাই লন্ডনের রাজপথে তারা স্লোগান তোলেন কাজ, বিকাশ ও ন্যায়বিচারের স্বপক্ষে। আর মার্কিন পত্রিকা টাইমসের রবিবারের সকালের শিরোনাম, 'সরকারী ব্যয় বরাদ্দের প্রতিবাদে বিকল্পের অভিযান'।
শনিবার লন্ডনের অক্সফোর্ড স্কোয়ারে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিস এবং নিরাপত্তা রক্ষীরা অভিযান চালায়। এই হামলার ঘটনায় কয়েকজন আন্দোলনকারীর আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পাশাপাশি ট্রাফলগার স্কোয়ারেও আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিতে হামলা চালায় পুলিস। অন্যদিকে হাইড পার্কে সমবেত মানুষের সামনে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের সরকারের ব্যয়সঙ্কোচনের নীতির প্রতিবাদে ভাষণ দেন লেবার পার্টি'র নেতা এড মিলিব্যান্ড। এর আগে সরকারের ব্যয় ছাঁটাইয়ের নীতির কারণে সাধারণ মানুষের উদ্বেগের কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন ব্রিটেনের শিক্ষা সচিব মাইকেল গোভ। অবশ্য সরকার তার নীতি থেকে সরবে না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। শনিবার লন্ডনে বিক্ষোভ আন্দোলন ঠেকাতে ৪হাজার ৫০০জন পুলিস কর্মী মোতায়েন করেছিলো প্রশাসন। একই সঙ্গে বিভিন্ন বড় ব্যবসা কেন্দ্র ও টিউব রেল স্টেশনের সামনেও অতিরিক্ত নিরাপত্তা রক্ষী নামানো হয়েছিলো। তবু বশ মানেনি মানুষের প্রতিবাদের মেজাজ।
কারণ, একদিকে যখন ছাত্রদের পড়াশোনার খরচ লাগামছাড়া। তখনই তাদের অভিভাবকদের কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাই প্রতিরোধের শনিবারের স্লোগান ছিলো 'বন্ধ কর ছাঁটাই'। উল্লেখ্য, ব্রিটেনের নানা প্রান্ত থেকে আস্ত ট্রেনের কামরা অথবা গোটা এক একটা বাস ভাড়া করে লন্ডনে আসেন হাজারে হাজারে সংগ্রামী মানুষ। 'ছাঁটাইয়ের এই নীতির কারণে সাধারণ মানুষ বিশেষত সমাজের প্রান্তিক অংশের মানুষ কতটা প্রভাবিত হচ্ছেন তার সম্পর্কে সরকারের কোন ধারণাই নেই', মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে জানিয়েছেন ডাইন রিচার্ডস (৬২)। অ্যাবারউইথ থেকে প্রতিবাদ আন্দোলনে যোগ দিতে তিনি লন্ডনে এসেছিলেন।
শনিবার টেমসের পাড় তেতে উঠেছিলো প্রতিবাদী মানুষের বর্ণময় উপস্থিতিতে। লন্ডনের আকাশেও ছিলো আন্দোলনকারীদের হাতের অর্গলমুক্ত গ্যাস বেলুনের সংগ্রামী মেজাজে ফোটানো নো-ফ্লাই জোনের ঝকঝকে নিশান। শহরের বিভিন্ন রাজপথে ছিলো একাধিক মিছিল। অনেকেই বাড়ির কচি-কাচাদেরও নিয়ে
এসেছিলেন এই মিছিলে। অবশ্য নিত্যদিনের জীবন যন্ত্রণা অনেক ক্ষেত্রেই আন্দোলনকে অগ্নিগর্ভ করে তোলে। লেইসিস্টার স্কোয়ার, পিকাডেলি সার্কাস্ এবং মে ফেয়ার-সহ বেশ কিছু অঞ্চলে আন্দোলনকারীরা ধোঁয়া বোমা, কাচের বোতল, টিউব লাইট পুলিসকে লক্ষ্য করে ছোঁড়ে। আবার শহরের অনেক অংশে আন্দোলনকারীরা গান গেয়ে, সমবেত নৃত্যে অথবা বাজনার তালে তালে সরকার বিরোধী এই প্রতিবাদকে আক্ষরিক অর্থেই বাঙ্ময় করে তোলেন। এদিনই লন্ডনে সরকারের ছাঁটাইয়ের নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে আরো জোরদার করার কথা ঘোষণা করেন টি ইউ সি'র সাধারণ সম্পাদক ব্রেনডেন বারবার।
বিরোধীরা চায় না বেকারদের
কাজ হোক : নিরুপম সেন
নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি, ২৭শে মার্চ — পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা আক্রান্ত। ঘরছাড়া হয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। খুন হয়েছে আমাদের বহু কর্মী। তাই এবারের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচনে গুরুত্ব দিতে হবে নিবিড় প্রচারের উপর। কথাগুলি বলেছেন সি পি আই (এম) পলিট ব্যুরো সদস্য নিরুপম সেন। রবিবার বিকেলে দার্জিলিঙ জেলা বামফ্রন্টের ডাকে শিলিগুড়ি বিধানসভা কেন্দ্রে অশোক ভট্টাচার্য এবং ডাবগ্রাম ফুলবাড়ি কেন্দ্রের প্রার্থী দিলীপ সিংয়ের সমর্থনে তিনি বক্তব্য রাখেন। কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গনে অনুষ্ঠিত এই সভায় এছাড়াও বক্তব্য রাখেন পৌরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য, জীবেশ সরকার এবং সি পি আই দার্জিলিঙ জেলা সম্পাদক উজ্জ্বল চৌধুরী। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক অনিরুদ্ধ বসু, আর এস পি-র তাপস গোস্বামী প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ সি পি আই (এম) নেতা গৌর চক্রবর্তী। বাল্মীকি বিদ্যাপীঠ ময়দানে আয়োজিত অপর এক সভায় বক্তব্য রাখেন প্রার্থী দিলীপ সিং, দিবস চৌবে প্রমুখ। এখানে সভাপতিত্ব করেন উদয় দাস। দু'টি সভাতেই কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
নিরুপম সেন বলেন, ৩৪ বছর ধরে আমরা শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। যা আমাদের শক্তির প্রধান উৎস। আর এই ঐক্যের উপরেই আঘাত আসছে চরম দক্ষিণ ও বামপন্থীদের দিক থেকে। প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে একের পর এক মিথ্যে প্রচার করে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সারা দেশের মধ্যে এরাজ্যেই প্রথম ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে থাকা পৌরসভাগুলিরও নির্বাচন হয়। ১৮ বছর বয়সে ভোটাধিকার দেওয়া হয়। পঞ্চায়েত ও পৌর আইন বিভিন্ন সময়ে সংশোধন করে মানুষের হাতে আরো বেশি ক্ষমতা দিতে পেরেছি আমরা।
নিরুপম সেন বলেন, ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণ বিলের পর এবার পেনশনের উপরেও কোপ বসালো কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকার। পেনশনের টাকা শেয়ার বাজারে খাটানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে অবসর প্রাপ্ত কর্মীদের। ২০০৪ সালে আমরা বাইরে থেকে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে প্রথম ইউ পি এ সরকারকে সমর্থন জানিয়েছিলাম। শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থবিরোধী কোন কাজ করতে দিইনি। বামপন্থীদের চাপেই ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প শুরু হয়েছিলো। ২০০৯ সালে ফের দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এবারে তৃণমূল কংগ্রেস ওদের সঙ্গী। কেন্দ্রের প্রতিটি জনস্বার্থবিরোধী কাজেই তৃণমূল কংগ্রেসের মদত রয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি ও ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করেনি তারা।
রেলমন্ত্রীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ২০ মাস হলো তিনি রেলমন্ত্রী। উদ্বৃত্ত তহবিল ২৫ হাজার কোটি টাকা থেকে এখন এসে ঠেকেছে ১৩০০ কোটি টাকায়। নতুন লাইন বসেনি। স্টেশন হবার আগেই নামকরণ হয়ে যাচ্ছে। এরাজ্যে ওদের মুখে উন্নয়নের কথা মানায় না। কারখানার মাধ্যমে কর্মসংস্থান হোক তা ওরা চায় না। তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হয়েছে। রাস্তা করতে দেয়নি। বিদ্যুতের কারখানা করতে দেয়নি। যেখানে যেমনভাবে পেরেছে ধ্বংস করেছে। সেতু ভেঙেছে, রাস্তা কেটেছে। গোটা রাজ্য জুড়ে তৃণমূল কংগ্রেস হিংসার পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে। একটা ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারের পদধ্বনি আমরা শুনতে পাচ্ছি। এই অশুভ শক্তিকে যদি আটকাতে না পারি তাহলে শ্রমজীবী মানুষের সামনে ভয়ঙ্কর কালো দিন নেমে আসবে। এই সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে পরাস্ত করেই অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গঠনের লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
No comments:
Post a Comment