Thursday, August 22, 2013

বাঘের পিঠে বিমল গুরুং

বাঘের পিঠে বিমল গুরুং

বাঘের পিঠে বিমল গুরুং
কালিম্পংয়ে মোর্চার অফিসে প্রস্তাবিত গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের মানচিত্র। ছবি-- মণিপুষ্পক সেনগুপ্ত
গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে তেতে ওঠা পাহাড়ে এখন শাঁখের করাতে মোর্চার সর্বময় কর্তা। কোনও মূল্যেই গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে সরতে নারাজ পাহাড়বাসী। সরকারের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে নেমে গোর্খাল্যান্ড আনতে না-পারলে পাহাড় ছাড়তে হবে গুরুংকে। দার্জিলিং থেকে লিখছেন মণিপুষ্পকসেনগুপ্ত

মদ ছুঁয়েও দেখেন না বিমল গুরুং৷ নেশা বলতে ছিল খৈনি৷ কিন্ত্ত 'লাইমলাইট'-এ আসার পর তা-ও ছেড়ে দিয়েছেন৷ হাওয়াই চটি আর পরেন না৷ পায়ে সব সময় বিদেশি ব্র্যান্ডের স্নিকার৷

গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন আমূল বদলে দিয়েছে গুরুংয়ের 'লাইফ স্টাইল'৷ আশির দশকে সুবাস ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় ট্যুরিস্ট গাড়ি চালাতেন গুরুং৷ পাহাড়ে কানাঘুসোয় শোনা যায়, বিমলের এখন নামে বেনামে ১৩টি স্করপিও গাড়ি রয়েছে৷ তাঁর ছেলেমেয়েরাও প্রতিষ্ঠিত৷ ছেলে নেপালি সিনেমার উঠতি নায়ক৷ মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করে৷ সে পারতপক্ষেও দার্জিলিংমুখো হয় না৷ ইংরাজি না বলতে পারার কারণে ইংরাজি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতে চান না গুরুং৷ তবে কেউ তাঁকে সময় জিজ্ঞাসা করলে, বা হাতের একলাখ টাকা দামের রোলেক্স ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ইংরাজিতেই 'টাইম' জানিয়ে দেন৷

এহেন বিমল গুরুংয়ের খাসতালুক দার্জিলিংয়ে ঢুকতে গেলেই চোখে পড়বে দেওয়ালে গোটা গোটা অক্ষরে বিভিন্ন জায়গায় লেখা 'ওয়েলকাম টু দি ল্যান্ড অফ গোর্খা'৷

বিভিন্ন মোড়কে বন্ধ৷ কোনও দিন 'ঘর ভিতর জনতা'৷ আবার কোনও দিন 'ঘরের বাইরে জনতা'৷ নাম যাই হোক, প্রভাবটা একই৷ শুনশান পাহাড়৷ দোকানপাট সবই বন্ধ৷ তবে পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে কথা বললে একটি বিষয় স্পষ্ট, এই বন্ধ কিন্ত্ত জনতার উপর গুরুংয়ের চাপিয়ে দেওয়া নয়৷ বরং গোর্খাল্যান্ড ইস্যুতে পাহাড়ের মানুষের আবেগই চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে গুরুংয়ের৷ অধিকাংশ পাহাড়বাসী যে কোনও মূল্যে গোর্খাল্যান্ড চান৷ আর সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা গুরুংয়ের কাছ থেকে কড়ায়-গণ্ডায় হিসেব বুঝে নিতে চান তাঁরা৷ কিছুদিন আগে মহাকরণ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনকে কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর গুরুং দুঁদে রাজনীতিবিদের কায়দায় কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত পাহাড়ের গোর্খাল্যান্ড সমর্থকরা কোনও কৌশলী রাজনীতিবিদকে তাঁদের নেতা হিসেবে দেখতে চান না৷ তাঁরা চান গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের নেতা হোক 'রাফ এন্ড টাফ'৷ যিনি গোলটেবিল বৈঠক করবেন না ঘণ্টার পর ঘণ্টা৷

মমতার সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে নেমে এই ভুলটাই করে ফেলেছেন গুরুং৷ সুবাস ঘিসিংকে পাহাড়ছাড়া করেছিলেন গুরুং৷ সেই গুরুংকেই চান পাহাড়ের মানুষ৷ দার্জিলিংয়ের জিমখানা ক্লাবে গম্ভীর মুখে সর্বদল বৈঠক করা বিমল গুরুং তাই গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে সোচ্চার হওয়া পাহাড়ের মানুষের কাছে অচেনা৷

জিমখানা ক্লাবে সে দিন সর্বদল বৈঠকে অনেকে হাজির হলেও গুরুং তখনও এসে পেঁৗছননি৷ হঠাত্‍ই একদল যুবক হাজির জিমখানায়৷ হাতে লিফলেট৷ সেগুলি বিলি করতে করতে তাঁদের মধ্যে একজন বললেন, 'আমার দাদু গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন করে জেলে গিয়েছিলেন৷ আমার বাবা ঘিসিংয়ের ডাকে আন্দোলন করতে গিয়ে সিআরপিএফের গুলিতে মারা গিয়েছিলন৷ এখন আমি আন্দোলন করছি৷ আর কতদিন অপেক্ষা করব স্বপ্নের গোর্খাল্যান্ডের জন্য? মিটিং করে কিছু হবে না৷ রাস্তায় নামতে হবে৷ সেটাই আমরা বিমল দাজুকে সাফ জানাতে এসেছি৷'

পাহাড়ের যুবকদের সেই বার্তা গুরুংকে ভাবালো কি না, কে জানে! কিন্ত্ত বাস্তব হল, ঘিসিংও যখন নয়ের দশকে কিছুটা থিতু হতে শুরু করেছেন, তখনও পাহাড়ে এ রকম ছোট ছোট বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠত৷ ঘিসিং পাত্তা দেননি৷ ভেবেছিলেন, পাহাড়ে তাঁর চোখে চোখ রেখে কথা বলবে কে! গুরুংও হয়তো ক্ষমতার মসনদে বসে সে রকমই ভাবছেন৷

প্রতিদিন পাতলেবাসের বাড়ি থেকে সিংমারি পার্টি অফিসে গুরুং আসেন একটি সাদা রঙের স্করপিও চেপে৷ এক রসিক মোর্চা নেতার কথায়, 'আসলে আমাদের প্রেসিডেন্ট স্করপিও গাড়ি নয়, পাহাড়ের মানুষের সেন্টিমেন্ট নামক বাঘের পিঠে চেপে বসে আছেন৷ বাঘের পিঠ থেকে নামলে পাহাড়ের মানুষ গুরুংকেও ঘিসিং বানিয়ে ছাড়বে৷ আর বাঘের পিঠে বসে থাকলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তাঁকে খাবে৷'

ঘটনা হল, মাসখানের আগেও গুরুং আঁচ করতে পারেননি পাহাড়ের মানুষ গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সঙ্গে এতটা জড়িয়ে পড়েছেন৷ ১৯০৭ সাল থেকে যে আন্দোলনের সূত্রপাত ২০১৩-তে সেই আন্দোলন তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েছে৷ গুরুংয়ের 'দুর্ভাগ্য' পৃথক রাজ্যের দাবিতে পাহাড়ের মানুষ যখন ফুটছেন, তখন সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে তাঁকেই৷ প্রশ্ন হচ্ছে, এতবড় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা কি গুরুংয়ের আছে?

সম্ভবত, গুরুং নিজেও তা মনে করেন না৷ তাই জিটিএ-র মাথায় বসে আগামী পাঁচ বছর সুখে শান্তিতে কাটিয়ে দেওয়াই তাঁর পরিকল্পনা ছিল৷ জিটিএ-র মেয়াদ দু'বছর হতে চলল, তার মধ্যেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন অনেক মোর্চা নেতা৷ জিটিএ-র টাকা নয়ছয় করে এক মোর্চা নেতা বর্তমানে ১২টি হোটেলের মালিক৷ গুরুংও বাড়ি গাড়ি করে বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন৷ বাড়িতে সার্চ লাইট, বিদেশি কুকুর, সশস্ত্র প্রহরী-- কিছুরই অভাব নেই৷ গুরুং-ঘনিষ্ঠ এক মোর্চা নেতার কথায়, 'ছোটবেলা থেকেই ব্যাডমিন্টন খেলতে ভালোবাসতেন প্রেসিডেন্ট৷ কিন্ত্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় জিমখানা ক্লাবে বড়লোক ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলার সুযোগ তাঁর ছিল না৷ এখন সেই গুরং নিজের বাড়িতেই কয়েক লাখ টাকা খরচ করে ইন্ডোর ব্যাডমিন্টন ক্লাব তৈরি করেছেন৷'

সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল৷ ঘিসিংয়ের মতো পাহাড়ের আগুনখেকো নেতা বিমল গুরুংও হয়তো সুখে-শান্তিতে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাইছিলেন৷ কিন্ত্ত আচমকাই তেলেঙ্গানার ঘটনার জেরে পাহাড়ের ছবিটা বদলে গেল৷ তেলেঙ্গানা যদি আলাদা রাজ্য হতে পারে, তবে গোর্খাল্যান্ড নয় কেন? এই দাবিতে গর্জে ওঠে পাহাড়৷ পাহাড়ের মানুষের 'ইমোশন'কে গুরুত্ব না দিয়ে তখন গুরুংয়ের কাছে কোনও উপায় ছিল না৷ পাহাড়ে 'বেতাজ বাদশা'র গদি অক্ষত রাখার জন্যই তাঁকে পদত্যাগ করতে হয় জিটিএ থেকে৷ কারণ, তিনি বিলক্ষণ জানেন, একবার রাজ্য সরকারের সঙ্গে আপোসের পথে হাঁটলে তাঁর পরিণতিও হবে ঘিসিংয়ের মতো৷
'পাহাড় সম্রাট'-এর গদি চিরস্থায়ী নয়৷ গুরুংয়ের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন অনেকেই৷ যদিও তিনি মনেপ্রাণে জিটিএ ভেঙে দেওয়ার বিরোধী৷ তাই নিজে ইস্তফা দিলেও বাকি সদস্যদের জিটিএ থেকে পদত্যাগ করতে দেননি৷ আবার জিটিএ থাকবে এ-কথাও গুরুং জোর গলায় বলতে পারছেন না৷ কারণ, পাহাড়ের মানুষ আর জিটিএ চান না৷ তেলেঙ্গানার মতো তাঁরাও গোর্খাল্যান্ড চান৷ গুরুং জানেন, একবার পাহাড়ের মানুষের মন থেকে দূরে সরে গেলে তাঁর গদি বেদখল হতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না৷

যদিও মোর্চা নেতাদের ব্যাখ্যা, জিটিএ ভেঙে দেওয়া গুরুংয়ের শেষ তাস৷ সেটা এখনই হাতছাড়া করতে চান না তিনি৷ আগামী ২৯ অগস্ট জিটিএ-র মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করছেন৷

পাহাড়ে একটি প্রবাদ আছে৷ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা হল পাহাড়ের তৃণমূল৷ 'ওয়ানম্যান পার্টি'৷ তৃণমূলে মমতার মুখের উপর কথা বলার সাহস যেমন কোনও নেতার নেই তেমনই, মোর্চায় বিমল গুরুং৷

এখন পর্যন্ত তাই আছে৷ গুরংই পাহাড়ের শেষ কথা৷ তাঁর দামি ঘড়ি, দামি গাড়ি, বিলাসবহুল জীবন--এই সব কিছুই পাহাড়ের মানুষ দেখেও না দেখার ভান করে আছেন৷ কিন্ত্ত যে দিন তাঁরা বুঝবেন, এই গুরুংয়ের নেতৃত্বে কোনওদিনই দার্জিলিংয়ে ঢোকার মুখে সরকারি ভাবে লেখা যাবে না, 'ওয়েলকাম টু দি গোর্খাল্যান্ড', সে দিন কিন্ত্ত গুরুংকেও রাতের অন্ধকারে পাহাড় ছেড়ে পালাতে হবে৷

'শতরঞ্জ কি খিলাড়ি' তো প্রস্ত্তত৷ আপনি?

No comments:

Post a Comment