দেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলোয় একাত্তর পন্থী সব মানুষের রক্তমূল্য কি কুকুর
বেড়ালের চেয়েও কম দামি?
গতকাল রাতে ফেসবুকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে স্থানীয় মসজিদের মাইক থেকে মিথ্যে সংবাদ পরিবেশন (আওয়ামি লীগের ছেলেরা মসজিদের ইমামকে হত্যা করেছে এবং মসজিদে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে) করার পর স্থানীয় জনতা ও জামাত-শিবির মিলে ছাত্রলীগের আট জন তরুণকে হত্যা করেছে পড়ার পর থেকে খুব বিষণœ বোধ করছিলাম। সকালে উঠে দেশের একাধিক সংবাদপত্র দেখে অবাক হলাম। একটি বড় পত্রিকায় সংবাদটি এমন ভাবে প্রকাশিত হয়েছে যেন দোষ আওয়ামি লীগেরই। যেন আওয়ামি লীগের গুন্ডা ছেলেদের মোটর শোভাযাত্রায় কেউ বা কারো হামলায় 'তিন' জন মারা গেছে। আওয়ামি লীগ দাবি করছে তারা জামাত-শিবির। তারপরও ফেসবুকে বসার প্রাণপন ইচ্ছাটা তখনকার মত কবর দিলাম। পরশু বাংলা নববর্ষ। নববর্ষের আগে আমি গোটা ঘর নিজের হাতে ঝেড়ে-মুছেÑধুয়ে ঝকঝক করি। সেই কাজই করলাম দিনভর। বিকেলে বাসার বিশেষত: বাচ্চাদের জন্য (দেশে থাকা আমার একটিই ভাইয়ের দুই শিশু পুত্র ও কন্যা) কেনাকাটা করতে বের হলাম। এসব সেরে রাতে খাবার টেবিলে মাত্রই আমার বড় বোণের কাছ থেকে জানতে পারলাম চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ৩০ জন আওয়ামি লীগের তরুণকে খুন করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। যারা মেরেছে তারা মুসলিম। যাদের মারা হয়েছে তারাও মুসলিম। আমি মুসলিম নই। আমি অন্য ধর্মের মানুষ। হয়তো এক্ষেত্রে আমার মন্তব্য করা একান্তই অসঙ্গত। তবু যে 'মুসলিম'রা স্বধর্মের মানুষকেই শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ভিন্নতার কারণে প্রার্থনা বা উপাসনালয় থেকে মাইকে মিথ্যে কথা প্রচার করে এমন হত্যা করতে পারে...আপনারা কি সত্যিই আপনাদের 'ধর্ম'কে ভালবাসেন? আপনারা কি অবমাননা করছেন না আপনাদেরই খুব ভালবাসার আল্লাহ ও রাসুলকে? আমাদের মানে বিধর্মীদের শ'য় শ'য় মন্দির যখন আপনারা পোড়ান, না হয় বুঝলাম আমরা বিধর্মী বলে আমাদের আপনারা ঘৃণা করেন। কিšত্ত স্বধর্মী মানুষদের সাথেও এই আচরণ? তাহলে...আমরা...সো-কলড বিধর্মীরা আপনাদের আসলে কি চোখে দেখব? কিম্বা কোন চোখে দেখা উচিত বলে আপনাদের বোধ হয়? আজ ফেসবুকে জন্মসূত্রে শ'য়ে শ'য়ে মুসলিম ছেলে-মেয়েই যে তাদের ধর্ম নিয়ে সমালোচনা মুখর হচ্ছে, সেটা কিšত্ত আপনাদের জন্যই। এই আপনারাই একাত্তরে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সহ ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা আর চার লক্ষ নারীর সম্ভ্রমহানির রক্তে হাত রাঙিয়েছেন। আপনারাই টুইন টাওয়ারে বোমা ফেলেন, ভারতের সংসদ ভবনে হামলা করেন, বালিদ্বীপ আর রাশিয়ার পাতাল রেলে বোমা ফেলেন। আপনারাই পাকিস্থানে মালালার মাথায় গুলি করেন, মসজিদে বোমা ফেলেন আর আফগানিস্থানে মেয়েদের পড়তে দেন না, শিশুদের পোলিও টিকা নেওয়া পর্যন্ত অনৈসলামিক বলে বাড়িয়ে তুলছেন বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা। সারা দুনিয়া কালাশনিকভ আর বোমায় ত্রস্ত করে দিনের শেষে বলবেন 'ইসলাম শ্রেষ্ঠ ধর্ম' আর 'ইসলাম শান্তির ধর্ম'? মানবে কেন মানুষ? আমরা অমুসলিমরা ত' বটেই, আপনাদের ধর্মেরই অনেক মানুষ আজ মানতে চাচ্ছে না।
ভাবা কি যায় কোন হিন্দু মন্দির বা গির্জা থেকে পুরোহিত বা পাদ্রিরা মাইকে মিথ্যা কথ্যা বলে নিষ্পাপ ব্যক্তি খুনের উন্মাদনা ছড়াবে (হোক স্বধর্মী বা বিধর্মী)? এই আপনারাই স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছেন। বাদ যায় নি দশ বছরের শিশু রাসেল বা মুজিবের অন্তসত্বা পুত্রবধূরাও। তারপর আপনারা (মোশতাক-সায়েম-জিয়া-এরশাদ-খালেদা-তারেক চক্র) খুন করলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক খালেদ মোশাররফ সহ অগণিত মুক্তিযুদ্ধ পন্থী সেনা অফিসারকে। এরশাদের সময়ে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার দু'বছর আগেই মসজিদ ভেঙ্গেছে বলে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে 'ইনকিলাব' বাঁধালো রায়ট। ভাঙ্গল শ'য়ে শ'য়ে মন্দির। ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর আর একদফা শ'য় শ'য় মন্দির ভাঙ্গা হলো। ভোলার প্রত্যন্ত জনপদগুলোয় ধর্ষণে নিশ্চল, নির্জীব পড়ে রইলো হিন্দু তরুণীরা। ১৯৯১-এ ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরের পাকিস্থানী সেনাপতিদের স্বেচ্ছায় মনোরঞ্জনকারীনী বেগম জিয়ার নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে দুপুরের খাবার সময়ে সহসা পুলিশ ঢুকে পড়ে 'রোজা'র দিনে খাবার অপরাধে হিন্দু ছেলেদের মর্মান্তিক প্রহার করলো। একদিনে প্রায় চারশ'র মত ছেলে গ্রেপ্তার হল বিনা দোষে। তার স্বামী জিয়াউর রহমান এদেশের বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ পাহাড়ি এলাকার মঙ্গোলীয় জনপদে দশকের পর দশক চালিয়েছিলেন এথনিক ক্লিনসিং। তাও ইসলামের নামে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামি লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশের কিছু সংবাদপত্র অদ্ভুত 'নিরপেক্ষ' আচরণ শুরু করলো। অস্বীকার করা যাবে না বৃহত্তর নোয়াখালিতে ফেনীর জয়নাল হাজারি কিছু সন্ত্রাস করেছেন। টিপু সুলতান নামে এক সাংবাদিক তাদের হাতে আহত হন। কিšত্ত সেই এক সাংবাদিকের নিপীড়নের ঘটনা সারা বছর ফলাও করে প্রচার করা হলো। অথচ ২০০১-এ বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসার পর তিনজন সাংবাদিক নিহত (মানিক সাহা-হুমায়ুন কবির বালু-শামসুল হক) ও এক সাংবাদিক (প্রবীর সিকদার) চিরতরে একটি পা হারালেও 'নিরপেক্ষ' সংবাদপত্রগুলো নিশ্চুপ রইলো। ২০০১-এ এসেই বিএনপি-জামাত তিন মাসে পাঁচশ'র কাছাকাছি মন্দির ধংস করল। শ'য়ে শ'য়ে নারী ধর্ষিতা হলেন। লুট হলো কোটি টাকার হিন্দু সম্পত্তি। সুশীলদের মানবাধিকার অক্ষত রইলো। জাগ্রত মুসলিম জনতা (জেএমবি) আর হরকাতুল জিহাদ বিএনপি-জামাতের প্রশ্রয়ে একযোগে দেশের ৬৩টি জেলায় বোমা হামলা করলো। মন্দির-গির্জা-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-যাত্রা-সার্কাস মায় সিলেটের সুফি মাজার বোমা হামলায় শেষ হলো। কানসাটে কৃষকদের হত্যা করা হলো। নারায়ণগঞ্জে গুলি করা হলো পোশাক শ্রমিকদের। তারেক-কোকোর কোটি কোটি টাকা লুটপাট। সব সুশীল নিশ্চুপ। বামপন্থী-সুশীল-নিরপেক্ষদের 'তোতাপড়া'য় আমিও বিশ্বাস করতে শিখেছি ১৯৭২-৭৫ এর মুজিব শাসন ছিল কালো শাসন। বিএনপির থেকে আওয়ামি লীগ আর ভাল কি করে? আমি প্রাণপনে 'নিরপেক্ষ' থাকতে চাই। নিজের নি:শ্বাসের বিরুদ্ধে গিযে 'নিরপেক্ষ' থাকার চেষ্টা করি। যেন আমার অনারব বা অÑফার্সি নামটির জন্য আমাকে 'আওয়ামি লীগ' আর 'ভারতের দালাল' বলা না হয়।
২০০৮-এ আওয়ামি লীগের বিজয়ের পরপরই বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা কি জামাত-বিএনপি চক্রেরই চক্রান্ত না? শেখ হাসিনা অসম্ভব রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতি মানবিক ভাবে নিয়ন্ত্রণে আনলেন। আওয়ামি সরকারের উদার আবহের সুযোগ নিতে শুরু করলাম আমরা সবাই। ২০০১-এ শ'য় শ'য় হিন্দু নারীর নিপীড়নের সময় চুপ ছিলাম। অথচ এক লিমনের ক্রসফায়ার নিয়ে লিখে ফেসবুকে ঝড় তুললাম। মানব বন্ধনও আয়োজন করলাম। বাকশালি, ফ্যাসিবাদী সরকার বলে কথা! খালেদা জিয়াকে এক টাকায় ভাড়ায় দীর্ঘ দিন ভোগ করা ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছাড়তে হলো বলে ইংরেজি ভাষার যাবতীয় শব্দশৈলী উপুড় করে রাহনুমা আহমেদ (বাংলাদেশে এই একজন নারীর বৈদগ্ধ্যকে আমি সত্যিই সমীহ করি) শেখ হাসিনাকে কি ধোওয়াই না ধুলেন পাকিস্থান পন্থী 'দ্য নিউ এজ'-এ। আমি 'নিরপেক্ষ' হবার আশায় প্রাণপনে সেই লেখার প্রশংসা করলাম। কিšত্ত যত দিন যায় আমি দেখি আমার মস্কো-পিকিং নির্বিশেষে সব 'বাম-সুশীল-নিরপেক্ষ' বান্ধবরা ক্রিকেটে পাকিস্থান দলের সমর্থক। আমি বলি না তাদের ভারত সমর্থক হতে হবে। ভারতীয় দলের থেকে ইন ফ্যাক্ট পাকিস্থান দল অনেক বেশি স্নায়ুর চাপ সয়ে খেলতে পারে। অনেক পেছনে থেকেও খেলায় শেষ মূর্তে জিতে যেতে পারে। তাদের খুব ভাল কিছু ফাস্ট বোলার আছে। ভারতীয় দলের কিছু ব্যাটসম্যান আর স্পিনার সম্বল।এত বছর ক্রিকেট খেলেও তাদের ফাস্ট বোলার নেই। আমার প্রিয় দল সাউথ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়া। হারু ভারত আমার ভাল লাগে না। তাই বলে জয়ী পাকিস্থানকেও আমি সমর্থন করতে পারি না...চার লক্ষ নারীর ধর্ষণের স্মৃতি আমাকে তাড়ায়। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এখন বাংলাদেশ নিজেই খেলছে। কিšত্ত, মার্ক্স পড়া মানুষরা কি করে পাকিস্থানের মত একটা সর্ব অর্থে ইতর দেশের আপ্রাণ সমর্থক হতে পারে? কেন ভারত মানেই ঘৃণা? হিন্দু বলে? বিধর্মী বলে? পাশাপাশি আওয়ামি লীগের যে ছেলেদের দূর থেকে 'ভয়' পাওয়া শিখেছিলাম, তারাই দেখি 'হিন্দু' বা 'ভারত' বলতেই 'ঘৃণা' করে না, পাকিস্থান ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে লেখে...হ্যাঁ, তাদেরও আরবি-ফার্সি নাম। আবার বিএনপি বা বামদের থেকে আওয়ামি লীগের ছেলে-মেয়েরা বাস্তব জীবনে ইসলাম ধর্ম বেশি পালন করে। রোজা-নামাজ বেশি বেশি করে। আবার দিব্যি তারা অন্য ধর্মের মানুষদের সাথে স্বচ্ছন্দে এককাট্টা হয়ে চলা-ফেরা করে। বিএনপি বা বামরাই ত' বেশি মদ খায়, বেশি ফ্যাশনেবল!
মূল প্রসঙ্গে আসি। ইসলামের নাম করে একাত্তরের খুনী-ধর্ষক সাঈদিকে চাঁদে দেখতে পেয়ে যারা চারশ মন্দির ভাঙ্গল তাদের বিরুদ্ধে মানবতা ভঙ্গের অভিযোগ আনেন না কোন ফরহাদ মজহার-আসিফ নজরুল-নূরুল কবির-রাহনুমা আহমেদ (ওহ্, 'নিউ এজ'-এ চাকরি করা একটি ছেলে গতকাল নাম অপ্রকাশের শর্তে জানিয়েছে নূরুল কবিরা নাকি ভয়ানক জিয়া ভক্ত। সাবাশ! এই না হলে ধানের শীষ বাম!)। শিবিরের আট জন কর্মীর মৃত্যুতে সেদিন দু:খ প্রকাশ করলো অনুজ লেখক ও সাংবাদিক তৈমুর রেজা। হায় মানবাধিকারবাদীরা, রিক্সা থেকে বিবাহিত হিন্দু দম্পতিকে নামিয়ে হেফাজত কর্মীদের বিয়ের কাগজ দেখতে চাওয়ায় তোমাদের মানবাধিকার যায় না। আওয়ামি লীগের ত্রিশ জন ছেলেকে তাদেরই দল ক্ষমতায় থাকতে মিথ্যা পুঁতে ফেললেও তোমাদের মানবাধিকার যায় না! রাস্তার গুন্ডা বাড়ির ছোট ছেলেকে মারলে ভদ্রলোক বাবা মা যেমন গুন্ডাকে কিছু না বলে মার খাওয়া ছেলেকেই আবার মরে, এই সরকার তেমন ভাবে নিজের মানুষকেই জেলে পুরছে। বিপক্ষের হত্যা-অগ্নি সংযোগ-ত্রাস সহ্য করেও সে 'ফ্যাসিস্ট।' সবাইকে চিনে রাখা গেল। একটা কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। এদেশের প্রধান সব সংবাদপত্র ও টিভি মাধ্যম, বুদ্ধিজীবী আর বামদের কাছে আজ অমুসলিম ও ধর্মনিরপেক্ষ, উদার মুসলিম তথা একাত্তর পন্থী সব মানুষের রক্তমূল্য কুকুর বিড়ালের চেয়েও কম।
১৩ এপ্রিল।
সকাল ১২:১৬।
No comments:
Post a Comment