Wednesday, May 27, 2015

কু-রাজনীতি এবং সালাহ উদ্দিন-জাফর ইকবাল... -গোলাম মোর্তোজা

কু-রাজনীতি এবং সালাহ উদ্দিন-জাফর ইকবাল... 

-গোলাম মোর্তোজা  

ক. 'গুম' 'নিখোঁজ' হলেন ঢাকার উত্তরা থেকে। সন্ধান মিলল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ের অভিজাত 'গলফ-লিংক' এলাকায়।
খ. 'মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে'- সিনেমাটি দেখিনি, তবে ডায়ালগটির সঙ্গে পরিচিত।

বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদ 'নিখোঁজ' বা 'গুম' হয়েছিলেন ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাতে। তার সন্ধান মিলল ৬৩ দিন পরে শিলংয়ে। নিখোঁজ অবস্থাতেও তাকে নিয়ে অপরাজনীতি হয়েছে, সন্ধান পাওয়ার পর তা কু-রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। অপ বা কু-রাজনীতি শুধু সালাহ উদ্দিনের ক্ষেত্রেই নয়, মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ আরও অনেক সম্মানিত শ্রদ্ধেয় মানুষকে নিয়েও চলছে। প্রধান বিচারপতিকে বলা হচ্ছে 'হিন্দু বিচারপতি'। জাফর ইকবালের গালে জুতা মারতে চাইছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন। সালাহ উদ্দিনকে কেন চকচকে দেখাচ্ছে, সেই বিশ্লেষণও করছেন কু-রাজনীতি বিশ্লেষকরা। নারী-শিশু নিপীড়ক 'দুষ্টু'দের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের ঘাটতি হচ্ছে না। এসব বিষয় নিয়ে কিছু কথা।
১. ১০ মার্চ রাতে উত্তরার একটি ফ্ল্যাট থেকে সালাহ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কারা ধরে নিয়ে যায়, বিল্ডিংয়ের দারোয়ান সেই সময় গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে বলেছেন, যারা একজনকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেছেন, তারা নিজেদেরকে 'ডিবি' বলে পরিচয় দিয়েছিলেন।
আশপাশের আরও কিছু বিল্ডিংয়ের নিরাপত্তা কর্মীরা গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে বলেছিলেন, তারা রাতে বাড়ির সামনে, রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যদের এবং তাদের গাড়ি দেখেছিলেন।
এই বক্তব্যগুলো পাওয়া গিয়েছিল ঘটনার দু-তিন দিন পর। তারপর থেকে কেউ আর এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। গণমাধ্যমকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন।
২. ওপরের প্রসঙ্গটি আলোচনা করছি এই কারণে যে, এখন সালাহ উদ্দিন বিষয়ক আলোচনায় আর এই প্রসঙ্গটি আসছে না। আলোচনায় আসছে, সালাহ উদ্দিনকে 'গুম' করা হয়েছিল, না তিনি নিজেই পালিয়ে-লুকিয়ে ছিলেন। সরকার-আওয়ামী লীগ 'গুম' করেছিল, না বিএনপি লুকিয়ে রেখে সরকারকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল, এসব প্রসঙ্গ নিয়ে।
সালাহ উদ্দিনকে নিয়ে 'ডিম আগে, না মুরগি আগে' জাতীয় আলোচনা চলছে।
৩. সালাহ উদ্দিনের সন্ধান জানার পর প্রথমে প্রয়োজন ছিল দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া। প্রথমে গুরুত্ব পাওয়া প্রয়োজন ছিল মানবিক দিকটি। ৬৩ দিন নিখোঁজ মানুষটির স্ত্রী-সন্তান, পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি প্রথম বিবেচনায় আসা প্রত্যাশিত ছিল। স্ত্রী তার স্বামীর জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছিলেন।
একজন মানুষের কতটা অসহায়ত্ব!
সরকারের প্রয়োজন ছিল স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর দেখা করানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার।
তারপর দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে থাকা মামলার তদন্ত-বিচার নিশ্চয়ই হবে। আমাদের রাজনীতির গতিপথ এখন আর তেমন সরল-সহজ-স্বাভাবিক নেই।
৪. 'সন্ধান পাওয়ায় প্রমাণ হলো, সালাহ উদ্দিনকে নিয়ে বিএনপি মিথ্যাচার করছিল'Ñ বললেন একজন মন্ত্রী। কোনো তথ্য এবং তদন্ত ছাড়া তিনি এ কথা বললেন। একই রকমের বক্তব্য দিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও। সালাহ উদ্দিন বিষয়ক কোনো তদন্ত না করে তিনিও কথা বললেন। সরকার-দলের অন্যান্য নেতা-মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের বক্তব্যও প্রায় অভিন্ন।
সরকারকে সমর্থন করে টেলিভিশন টকশোতে চলতে থাকল আলোচনা। '৬৩ দিন গুম থেকে কারও চেহারা এমন চকচকে থাকে না' 'চকচকে পালিশ করা জুতা তিনি কোথায় পেলেন!' 'চোখ বাঁধা থাকলে, চোখে চশমা আসল কোথা থেকে!' 'চোখে চশমা থাকলে তিনি বুঝলেন কী করে যে, মারুতি গাড়িতে করে তাকে নেয়া হয়েছে?'
মজার বিষয় হলো, সালাহ উদ্দিন বিষয়ক এসব আলোচনা হচ্ছিল পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ উদ্ধৃত করে। আরও মজার বিষয়, আজকে পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে সালাহ উদ্দিনের কথা হয়নি।
মেঘালয়ের দু'একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রথম দিন ছোট্ট করে সংবাদ প্রকাশ করে। দ্বিতীয় দিন একটু গুরুত্ব দিয়ে সালাহ উদ্দিনের সংবাদটি প্রকাশ করে। কারণ সালাহ উদ্দিন মেঘালয়ের গণমাধ্যমের কাছে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংবাদ ছিলেন না। তাদের সংবাদের তথ্যসূত্র ছিল পুলিশের থেকে পাওয়া বক্তব্য। ঢাকা থেকে যোগাযোগ করার পর মেঘালয়ের গণমাধ্যম যখন গুরুত্ব বুঝতে পারে, তত সময়ে পুলিশও সতর্ক হয়ে গেছে। বাংলাদেশের বা মেঘালয়ের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ আর থাকেনি।
বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম রিপোর্ট নয়, 'সৃজনশীল' গল্প লেখার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এখন মেঘালয়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী রয়েছেন, তারা কেউই সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাননি, পাচ্ছেন না।
৫. একটা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কতটা পচে গেলে, কতটা দুর্গন্ধ ছড়ালে, কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এমন অমানবিক আলোচনা করা যায়! সালাহ উদ্দিন একজন রাজনীতিবিদ। তার বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা, তার প্রেক্ষিতে সহিংসতা-পেট্রলবোমা-মানুষের দগ্ধ হওয়া... ইত্যাদি অভিযোগ আছে। যেকোনো অভিযোগের তদন্ত-প্রমাণ সাপেক্ষে অবশ্যই বিচার হতে হবে। কিন্তু মানবিকতা বলে তো একটি বিষয় আছে।
রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরেও সালাহ উদ্দিন একজন স্বামী, একজন পিতা, একজন সন্তান। আত্মীয় পরিজন, বন্ধু নিয়ে তারও জীবন। সেই বিবেচনা কোনো আলোচনাতে আসল না। যে আলোচনা হচ্ছে, তারও যদি কিছুটা ভিত্তি থাকত, বিশ্বাসযোগ্য তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যদি হতো আলোচনা-তাও না হয় একটা কথা থাকত, যুক্তি থাকত!
৬. এ তো গেল বিএনপির রাজনীতিক সালাহ উদ্দিনের কথা। এবার আসি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রসঙ্গে। তিনি সমাজে (শিশু থেকে বৃদ্ধ) কতটা গ্রহণযোগ্য শ্রদ্ধেয় অনুকরণীয় অনুসরণীয়, তা বলে বোঝানোর প্রয়োজন মনে করছি না। মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে চরম প্রতিকূল অবস্থাতেও যদি একজন মানুষও কথা বলেন, বিশ্বাস করি সেই মানুষটি হবেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আমেরিকার নিরাপদ নিশ্চিত জীবন রেখে দেশে ফিরে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। 'মুরতাদ' 'মৃত্যুর হুমকি' তার নিত্যসঙ্গী। জাফর ইকবাল একজন সহজ সরল মানুষ হিসেবে পরিচিত। তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তিনি যা বিশ্বাস করেন, তা বলেন। সত্য কথা বলেন, হিসেব করেন না যে কার পক্ষে বা কার বিরুদ্ধে যাবে বা যাচ্ছে। তবে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে 'যুক্তি আবেগ' অকল্পনীয় পর্যায়ের। নতুন প্রজন্ম ২০০৮-এর প্রথমবারের ভোটাররা যে মুক্তিযুদ্ধ-যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে রায় দিয়েছিল আমার বিশ্বাস তার পেছনে একক ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে ড. জাফর ইকবালের লেখার। তিনি যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প-উপন্যাস-নিবন্ধ-কলাম লিখে শিশু-কিশোর-কিশোরী এমনকি বড়দের কাছে পৌঁছেছেন, তা আর কেউ পারেননি। এমনকি হুমায়ূন আহমেদও না। কিছু না লিখতে চেয়েও অনেকখানি লিখে ফেললাম। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তিও এখন এই মানুষটির গালে জুতা মারতে চাইছে।
৭. সিলেট-৩ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ সামাদ চৌধুরী। গত ৯ মে একটি অনুষ্ঠানে জাফর ইকবাল সম্পর্কে বলেছেন, 'আমি যদি বড় কিছু হতাম তাহলে জাফর ইকবালকে কোর্ট পয়েন্টে ধরে এনে চাবুক মারতাম।'
সম্প্রতি অনলাইন লেখক অনন্ত বিজয় দাশ সিলেটে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের একটি মানববন্ধনে ড. জাফর ইকবাল বলেন, 'অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডকে স্পর্শকাতর বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন তা মৌলবাদীদের জন্য একটা গ্রিন সিগনাল। জয়ের বক্তব্যে মনে হচ্ছে- তোমরা এভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাও সরকার কিছুই করবে না। সরকার যেটা করছে এবং জয় যেটা বলছে, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। হত্যাকারীদের প্রশাসন ধরতে  পারছে না, সেটা আমি বিশ্বাস করি না। এটা সরকারের ব্যর্থতা। ... তোমরা যারা সত্যি কথা বলো, তোমাদের যেকোনো সময় মেরে ফেলা হবে, আমাদের মেরে ফেলা হবে, সরকার কিছুই করবে না। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিতে হবে।'
এই বক্তব্যের পর সাংসদ সামাদ চৌধুরী ও তার অনুসারীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড বিষয়ে রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জয় বলেছিলেন, 'আমরা একটি সরু রশির ওপর দিয়ে হাঁটছি। আমরা নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত হতে চাই না। আমার মা ব্যক্তিগতভাবে অভিজিতের বাবাকে সমবেদনা জানিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতটাই "অস্থির" যে, প্রকাশ্যে তার পক্ষে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব হয়নি।'
৮. ১৬ মে 'সিলেটবাসী'র ব্যানারে একটি মিছিল ও সামবেশ করে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্র্মীরা। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমেদ, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিজাম উদ্দিন, সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদসহ আরও অনেকে।
এই মিছিলের স্লোগান ছিল, 'সিলেটবিদ্বেষী জাফর ইকবাল, এই মুহূর্তে সিলেট ছাড়' 'হইহই রই রই, জাফর ইকবাল গেল কই' 'ব্লগার জাফর ইকবালের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও' 'জাফর ইকবালের দুই গালে জুতা মার তালে তালে।'
যারা এই লেখা পড়ছেন, বিশ্বাস করতে পারছেন এসব আওয়ামী লীগের মিছিলের সেøাগান!
৯. সাংসদ ৯ মে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন জাফর ইকবালকে নিয়ে, তার কোনো ব্যাখ্যা বা প্রতিবাদ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ করেনি, সাংসদকে তিরস্কার তো দূরের কথা। ১৬ মে'র বক্তব্য তো পুরো সিলেট বিভাগীয় আওয়ামী লীগেরই।
১০. এবার আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ওলামা লীগ সম্পর্কে দু-একটি কথা। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে (এসকে সিনহা) প্রধান বিচারপতি নিয়োগকে কেন্দ্র করে ওলামা লীগ মিছিল-মিটিং মানববন্ধন করেছে। সেখানে ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাওলানা মো. আবুল হাসান শেখ শরিয়তপুরী যে বক্তব্য রেখেছেন সেই বক্তব্য বাংলাদেশে কোনোদিন জামায়াত-হেফাজত-জঙ্গিরা রেখেছে কি না, সন্দেহ।
ওলামা লীগ সাধারণ সম্পাদক ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মানববন্ধনে যোগ দিয়ে বলেন, 'মুসলিমপ্রধান দেশে একজন হিন্দু বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি দেশের আইন প্রণয়নকারী সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদে হিন্দুদের পূজার অনুমতি দেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের পুলিশের এসআই পদে নিয়োগে ১৫২০ জনের মধ্যে হিন্দু নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৩৩৪ জন। ২০১১ সালে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইতে নিয়োগের ৯৩ জনের মধ্যে হিন্দু নিয়োগ করা হয়েছে ২৩ জন। সম্প্রতি ষষ্ঠ ব্যাচে সহকারী জজ পদে নিয়োগ দেয়া ১২৪ জনের মধ্যে ২২ জনই হিন্দু।'
১১. বর্তমান পৃথিবীতে তো বটেই বাংলাদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মতপ্রকাশ এবং মতামত গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত-শিবির। দেশে-বিদেশে অবস্থান করে তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধী প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালায়। তারপর আওয়ামী লীগ এই দিকটিতে জোর দেয়। এটা খুবই ভালো বিষয় হিসেবে প্রথমে পরিচিতিও পায়।
ক্রমান্বয়ে অধঃপতন দৃশ্যমান হতে থাকে। নেপথ্য নেতৃত্ব যাদের হাতে, তারা এটাকে রাষ্ট্রীয় শক্তির সমর্থন নিয়ে মানুষের চরিত্র হননে মেতে ওঠে। পুরোপুরি অসত্য, মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর তথ্য ব্যবহার করে অন্যায়ের প্রতিবাদকারী মানুষের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাতে শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'চরিত্রহননকারী এবং গালিবাজ' হিসেবে যাদের উত্থান দৃশ্যমান হয়, তাদের অধিকাংশই আওয়ামী রাজনীতির নেতা-কর্মী-সমর্থক। এদের মধ্যে একদল আবার নারী নিপীড়কের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়।
১২. এই নারী নিপীড়ক, চরিত্রহননকারী, গালিবাজরা প্রায় সবাই প্রোফাইল ও কাভার ফটো হিসেবে ব্যবহার করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ রাসেলের ছবি।
১৩. জাফর ইকবাল বিষয়ক বিষোদ্গার, ওলামা লীগের বক্তব্য বা ফেসবুকের গালিবাজদের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো বিকার লক্ষ করা যায় না। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়, রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনেই তারা এসব অপকর্ম করে।
১৪. বাংলাদেশ সমাজ-রাষ্ট্র এমন হয়ে গেছে, নিজের শরীরে থুথু না পড়া পর্যন্ত নড়াচড়া করি না। আবার অন্যের গায়ে থুথু দেয়াকে অনেক ক্ষেত্রে উৎসাহিত করি, সমর্থন করি। একজন আক্রান্ত হলে অন্যরা চুপ করে থাকার নীতি অবলম্বন করি। যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তারাও ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক ক্ষেত্রে এসব কর্মকাণ্ড সমর্থন করার দায়ে অভিযুক্ত।
জার্মান কবি অ্যাকটিভিস্ট মার্টিন নেমলার প্রথম জীবনে ছিলেন কমিউনিজম বিরোধী এবং হিটলারের সমর্থক। পরবর্তীতে তিনি হিটলার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার-নির্যাতনের শিকার হন। এখন যারা সব রকমের অন্যায়-অনিয়ম-অনৈতিকতা সমর্থন করছেন, চুপ থাকছেন, তাদের জন্যে তো বটেই, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জন্যে নেমলারের এই কবিতাটি খুব বেশি রকমের প্রাসঙ্গিক মনে করছি। বর্তমান পরিস্থিতি এর চেয়ে ভালোভাবে আর কিছু দিয়ে বোঝানো যায় বলে মনে হচ্ছে না।

'যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল,
আমি কোনো কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল,
আমি নীরব ছিলাম, কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,
আমি তখনও চুপ করে ছিলাম, কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,
আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোনো কথা বলল না,
কারণ, কথা বলার মত তখন আর
কেউ বেঁচে ছিল না।'



No comments:

Post a Comment