Tuesday, April 7, 2015

কার স্বার্থে নকশা ছাড়াই মেট্রোরেল নির্মাণে তোড়জোড়?

কার স্বার্থে নকশা ছাড়াই মেট্রোরেল নির্মাণে তোড়জোড়?

চূড়ান্ত নকশা না করেই রাজধানীতে মেট্রোরেল চালুর সময়সীমা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৪ বছর এগিয়ে এনেছে সরকার। ফলে রেললাইন নির্মাণে শুরু হয়ে গেছে তোড়জোড়। আর এজন্য ঢাকা গণপরিবহন কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ দরপত্র আহ্বানের অনুমোদনও দিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে। এক্ষেত্রে বিস্তারিত নকশা ছাড়া এ দরপত্র আহ্বান করা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে বলেও অনেকের অভিমত।

মেট্রোরেল প্রকল্পে এখন চলছে সয়েল টেস্টের কাজ। যার ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা হবে বিস্তারিত নকশা। এরপর জমি অধিগ্রহণ শেষে উড়ালপথ নির্মিত হবে। উড়াল পথের উপর থাকবে রেললাইন। অথচ এসব প্রাথমিক কাজ কিছুই হয়নি। কিন্তু রেললাইন নির্মাণ শুরু হয়ে গেছে তাড়াহুড়ো করে।

দেশে প্রায় সব প্রকল্প বাস্তবায়ন চলে অত্যন্ত ধীরগতিতে। কিন্তু তাই বলে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্ধারিত সময়ের আগে তাড়াহুড়ো করে শেষ করাও সমর্থনযোগ্য নয়। বিশেষ করে মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্প। এতে গুণগত বিচারে প্রকল্প বাস্তবায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চূড়ান্ত বিচারে দেশকে দিতে হবে তার খেসারত। সরকার যায়, সরকার আসে। কিন্তু দেশ ও দেশের জনস্বার্থ থাকে চিরস্থায়ী।

সরকার যে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন ৪ বছর এগিয়ে আনল তার পেছনে কোনো প্রযুক্তিগত সমর্থন আছে কি না তা কেউ জানে না। কারণ বিষয়টি কোনো রাজনৈতিক খামখেয়ালিপনার বিষয় হতে পারে না। সেই বিবেচনায় বাস্তবায়নের এ সময় এগিয়ে নিয়ে আসাটাকে আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ অভিমত ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয় বলে অনেকে মনে করেন।

জানা গেছে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার হবে রেলপথ এবং পুরোটাই উড়াল পথে। প্রতি স্থানের মাটির নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে বুয়েটে। সয়েল টেস্টের প্রতিবেদন পেতে সময় লাগবে ৬ থেকে ৮ মাস। মাটির গঠন অনুযায়ী বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করা হবে। সে অনুযায়ী জমি অধিগ্রহণ করা হবে। সুতরাং প্রকল্প বাস্তবায়নে আগে করণীয় হচ্ছে মাটি পরীক্ষা করে সেই ভিত্তিতে নকশা প্রণয়ন।

মন্ত্রণালয়ে সূত্রে জানা গেছে, আলোচিত মেট্রোরেলের বিস্তারিত নকশা ছাড়াই প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার কথা ছিল গত বছর জুলাই মাসে। কিন্তু এ প্রকল্পে নকশা তৈরি এবং নির্মাণকাজ তদারকির পরামর্শক প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ দেয়া হয়নি এখনো। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পর দুই-তিন বছর প্রকল্পটির কাজ হবে কাগজে-কলমেই। এর মধ্যে রয়েছে নকশা তৈরি, জমি অধিগ্রহণ, কোম্পানি গঠন, লোকবল নিয়োগ। এসব প্রক্রিয়া শেষে নির্মাণকাজ ২০১৬ সালের আগে শুরু করা সম্ভব নয়।

এদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরপ্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক বাংলামেইলকে বলেন, 'নকশা ছাড়া কোনো প্রকল্পই সফল হয় না। তাছাড়া নকশা ছাড়া কন্ট্রাকশনের কাজ শুরু করা হলে মাটির নীচে যে ইউটিলিটি লাইনগুলো আছে সেগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।'

তিনি বলেন, 'মেট্টোরেলের কাজ শুরু আগে মাটির ওপরে এবং নীচের লাইনের (ইউটিলিটি লাইন) সুষ্ঠু সমন্বয় করে নকশা করতে হবে। এই দুইয়ের সমন্বয় ছাড়া প্রকল্পের কাজ শুরু করা হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়। আমি যতদূর জানি বর্তমানে সমীক্ষার কাজ চলছে।'

জানা যায়, ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল উত্তরা থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে গিয়ে শেষ হবে। প্রকল্পের কাজ বছর দুয়েক আগেই শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুই দফা পথ পরিবর্তনের কারণে থমকে যায় কাজ।

প্রথমবার গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়কের কারণে এবং দ্বিতীয়বার বিমানবাহিনীর আপত্তির মুখে পথ পরিবর্তন করা হয়। প্রকল্পের জন্য তৈরি উন্নয়ন প্রস্তাবে (ডিপিপি) মেট্রোরেলের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা ঋণ দেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। বাকিটা সরকার বহন করবে। ইতিমধ্যে নকশা প্রণয়নসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য প্রথম পর্যায়ে প্রায় এক হাজার ১৮ কোটি টাকার ঋণ চুক্তি হয়েছে।

মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালে। তবে এর চার বছর আগেই, অর্থাৎ ২০২০ সালের মধ্যেই এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে। তবে পুরোটা নয়, প্রথম ২০১৯ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে ফার্মগেট এবং ২০২০ সালের মধ্যে ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরুর আগে তিনটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ এবং সরকার মালিকানাধীন একটি কোম্পানি গঠন করা হবে। সাধারণ পরামর্শকের কাজ হবে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন, নির্মাণকাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ ও তদারকি এবং মেট্রোরেল পরীক্ষামূলক চালানো। এই পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

চূড়ান্ত দরপত্রে জাপানের ওরিয়েন্টাল ও নিপ্পন কোই এবং ফ্রান্সের সিস্টার নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। পরামর্শক নিয়োগের পর ২০১৫ সালের মধ্যে বিস্তারিত নকশা তৈরি করা হবে। এই খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। মেট্রোরেল প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন সংস্থার বিধিবিধান ও জনবল কাঠামো এবং চাকরিবিধি তৈরি করার জন্য আরেকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হবে। ইতিমধ্যে ঠিকাদারদের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে জাপানের ওরিয়েন্টাল ও পেডেকো, স্পেনের এএলজি ও যুক্তরাজ্যের আইএমসি। তৃতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন করা। জাইকার ঋণের মূল শর্ত ছিল মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য শতভাগ সরকার মালিকানাধীন একটি কোম্পানি করা। ইতিমধ্যে ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) নামে একটি কোম্পানি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এবং জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে আবেদনও করা হয়েছে।

মেট্রোরেলের পথ ও স্টেশন:
মেট্রোরেলের পথ নিধারণ করা হয়েছে উত্তরা তৃতীয় পর্যায়, মিরপুরের পল্লবী, রোকেয়া সরণির পশ্চিম, সংসদ ভবনের দক্ষিণ সীমানা দিয়ে ফার্মগেট, শাহবাগ, টিএসসি, দোয়েল চত্বর, তোপখানা রোড হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত।

Metro-Rail


মেট্রোরেল পুরোটাই হবে উড়ালপথে। বিদ্যমান সড়কের মাঝখানে আড়াই মিটার জায়গা নেয়া হবে। উচ্চতা হবে মাটি থেকে আট থেকে ১৩ মিটার পর্যন্ত। মেট্রোরেলের জন্য ১৬টি স্টেশন প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- উত্তরার উত্তর, উত্তরা কেন্দ্র, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, আইএমটি, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও হোটেল স্টেশন, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম ও বাংলাদেশ ব্যাংক। স্টেশনগুলোও উপরে হবে এবং নিচ থেকে লিফট বা চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে যাত্রীদের ওপরে যাওয়ার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।

ডিপিপি অনুযায়ী, মেট্রোরেলে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী বহন করা যাবে। প্রতি সাড়ে তিন মিনিট পর পর একটি ট্রেন চলাচল করবে। ট্রেনের গতিবেগ ঘণ্টায় ৩২ কিলোমিটার। চলাচলকারী মোট ২৪টি ট্রেনের প্রতিটিতে ছয়টি বগি থাকবে। প্রতি ট্রেনে ৯৪২ জন বসে এবং ৭৫৪ জন দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে পারবে। মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য প্রতি ঘণ্টায় ১৩ দশমিক ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হবে বলে জানা যায়।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'মেট্রোরেল নেক্সট জেনারেশন প্রজেক্ট। মেট্রোরেলের ডিপোর জন্য রাজউক থেকে ১৪ একর জমি পাওয়া গেছে। বিস্তারিত নকশা ও নির্মাণ তদারকিতে পরামর্শ নিয়োগের মূল্যায়ন জাইকা'র সম্মতির জন্য পাঠানো হয়েছে। কোম্পানি গঠন শেষে জনবল নিয়োগ করার কথা জানান মন্ত্রী।' অংশীদারিত্বের ভিত্তিতেও মেট্রোরেল ব্যবস্থা স্থাপন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করার সুযোগ রাখা হয়েছে বলেও মন্ত্রী জানান।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) মেট্রোরেল প্রকল্প অনুমোদন হয়। বাস্তবায়নাধীন মেট্রোরেল লাইন-৬ এর আওতায় উত্তরা থেকে শুরু হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত যাবে। সময় লাগবে ৪০ মিনিটেরও কম।

http://www.banglamail24.com/news/2015/04/07/id/189461/

No comments:

Post a Comment