Thursday, April 4, 2013

‘নবকল্লোল’

WEDNESDAY, APRIL 3, 2013

'নবকল্লোল'

                                                                                     ।। সপ্তর্ষি বিশ্বাস।।
ছিল 'শুকতারা', ছিল 'নবকল্লোল'। 'শুকতারা' 'ছোটোদের' আর  'নবকল্লোল' 'বড়দের'। 'বড়দের' সুতরাং নিষিদ্ধ। আর তাই অক্ষরজ্ঞান ছয় কেলাসে উঠতে না উঠতেই অবরে সবরে 'নবকল্লোল' পেলেই যতোটা সম্ভব গো গেরাসে গিলে নেওয়া। আমার বাড়িতে যেহেতু 'নবকল্লোল'  আসতোনা  তাই লোভটা ছিল আরো বেশী। শিলচরে বড় মাসীর বাড়িতে দিদিরা তখন কলেজে। কাজেই সেখানে 'নবকল্লোল' আসতো, আসতো  'উলটোরথ'ও। বড়মাসীর বাড়ি গেলেই উল্টে পাল্টে দুয়ের স্বাদই নিতাম যথাসম্ভব। - হলদে কাগজে সিনেমার সাদাকালো ছবি লাল কিংবা নীল টোনে ছাপা –যেন আনতো প্রকৃত নিষিদ্ধতার স্বাদ। দোকান বাজার থেকে বাড়িতে আসা কখনো ঠোঙ্গাও তখন অনেক সময়ই হতো 'নবকল্লোল', 'উল্টোরথ'এর পাতায়। সেগুলিও নিস্তার পেতোনা আমার হাত থেকে। মনে আছে এমনি এক ঠোঙ্গার কাগজে একটি গল্প কিংবা উপন্যাসের একটি দৃশ্য পড়েছিলাম যেখানে ছেলের বিয়ের আলাপ নিয়ে মেয়ে দেখতে গিয়ে পাত্রের পিতা আবিষ্কার করছেন যে পাত্রীর মা তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা! হায়! তার পরে আর পড়া গেলোনা। ঠোঙ্গাটা এমন ভাবে বানানো যাতে কোন্‌ মাসের, কোন্‌ বছরের সংখ্যা তা ছিঁড়ে গেছে। অরূপ বলে একটি মেয়েলী ছেলে ছিল আমাদের ক্লাশে। সে একবার 'নবকল্লোল'এর পৃষ্ঠা ছিঁড়ে এনেছিল একটি ছবি যেখানে একটি পুরুষ একটি নারীকে চুম্বন করছে আর নীচে লেখা 'এখানে... এখানে অন্ধকার, এখানে আমাকে পিষে ফেলো সমীর ...' ঐ ছবির শিল্পী তুষার চ্যাটার্জী যিনি শুকতারায় 'কালো বাঘের থাবা' নামের গ্রাফিক-গল্প লিখতেন, আঁকতেন স্বপনকুমারের বিশ্বচক্র সিরিজের বই গুলির ছবি ... ফলে তাঁর রেখার ভঙ্গী, ছবির কিনারের দস্তখত তখন আমার চেনা। বাল্যের অবদমিত যৌনতা যে সবের স্পর্শে ক্রমে অবয়ব নিয়েছিল তাদের মধ্যে ইন্দ্রজাল কমিক্‌সের ডায়না পামার, নার্দা, বেলা'রা যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছে 'নবকল্লোল' আর 'উল্টোরথ' এর ঐসব ছবি আর ফটো ...
                  পরে, ক্রমে টের পেয়েছিলাম, যারা দুপাতা 'দেশ' আর তিনপাতা ইংরেজি পড়ে নিয়েছে তারা 'নবকল্লোল', 'উল্টোরথ' কে পাতে নেয়না, ঠিক যেমন শংকর বা নারায়ণ সান্যালকে। যেহেতু সেই 'দাদা'দের নকল না করলে 'ইন্টেলেক্‌চুয়াল' হওয়া যায়না তাই দাড়ি গোঁফ গজানোর আমলে আমিও ঐ সমস্ত মতামতের প্রচারক হয়ে কাটিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন। কিন্তু পরবর্তীতে যখন শংকরের 'কত অজানারে' আর 'চৌরঙ্গী' পড়লাম টের পেলাম ঐ সব 'দাদা'দের মতামতের অন্তঃশ্বাস শূন্যতা। নারায়ণ সান্যালের 'কাঁটা সিরিজ' তো অনন্য, জানিনা তাঁর ইতিহাস ভিত্তিক রচনাগুলি কতোজন পড়েছেন – এই মুহুর্তে মনে আসছে তাঁর ' দান্তে ও বিয়াত্রিচে' গ্রন্থটির কথা। 'দাদা'রা কি শচীন ভৌমিকের লেখা পড়ে দেখেছেন কোনোদিন? অন্ততঃ তাঁর 'অন্‌লী ফর এডাল্ট্‌স্‌' নামের বইটি? জানিনা। তবে সেই 'দাদা'রা যে রাজনারায়ন বসু বা সতীনাথ ভাদুড়ি'ও পড়ে দেখেননি, আজো না পড়েই বোলচাল চালান সে আমি নিশ্চিত। এতোকথা বলার হেতু এই' যে, এক 'শংকর' বাদে একটা সময় 'নবকল্লোল', 'উল্টোরথ' এর লেখক তালিকা আর 'দেশ' এর লেখক তালিকা হয়ে পরেছিল ভিন্ন। কিন্তু শুরুতে তেমন ছিলোনা। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে তারাশংকর সবার লেখাই ছাপা হয়েছে উল্টোরথ'এ। 
                  'নবকল্লোল' এর প্রকাশ ১৩৬৭ বাংলায় অর্থাৎ ১৯৬০ ইংরেজিতে। প্রকাশের সময় থেকেই এই পত্রিকা হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয়। পরে এতে সুনীল ইত্যাদিও লিখেছিল। তথাপি কালের হাওয়ায় সুনীল ইত্যাদি একটা সময় ফ্যাশান হয়ে উঠেছিল বলে সুনীলের অখাদ্য উপন্যাস গুলিকেও 'পাব্লিক' খাচ্ছিল 'ইন্টেলেক্‌চুয়াল' খাজা বলে আর বিমল মিত্র'র 'কড়ি দিয়ে কিনলাম'হেন অনবদ্য রচনাকেও 'বিয়ের উপহারের বই' এই সংজ্ঞার তিলক পরতে হয়েছিল। এই ঘটনার গহনে প্রথমে বুদ্ধদেব বসু দ্বারা আমদানীকৃত 'আধুনিকতা' উৎকট সংজ্ঞা ও পরে 'কৃত্তিবাস'মার্কা আধুনিকতার অবদান প্রবল। কিন্তু ঐ তিন চারজন মোদো-মাতালের হল্লাতে বাঙ্গালী ভুলে গিয়েছিল যে ঐ ভাঁড়দের স্বর্গ যে পাশ্চাত্য সেখানে কিন্তু এমন হয়না। সেখানে জর্জ সিমোনো তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু পেয়েছেন। স্বয়ং আন্দ্রে জিদ ছিলেন তাঁর মুগ্ধ পাঠক। স্বয়ং এলিয়ট সাহেব সিমোনোর পক্ষে মাঠে নেমেছিলেন নোবেল পুরষ্কারের জন্য। 
            
আজ এতো বছর পরে হঠাৎ দেখলাম 'নবকল্লোল' এর ৫০ বছরের নির্বাচিত গল্প প্রকাশিত হয়েছে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ( হায়, তিনিওতো আজ বিস্মৃতপ্রায়) নিজেই সম্পাদনা করেছেন এই সংগ্রহের। প্রকাশিত হয়েছে সেই 'দেব সাহিত্য কুটীর' থেকেই যে 'দেব সাহিত্য কুটীর' এর কৃপায় আমরা বাল্যকালে সুধীন্দ্রনাথ রাহা আর নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে প্রথম পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলাম বিশ্ব সাহিত্যের সমুদ্রে, চিনেছিলাম প্রিন্স্‌ মিশ্‌কিন্‌কে, অলিভার টুইষ্ট, জাঁ ভালজা'কে। দুই খন্ডে প্রকাশিত 'নবকল্লোল ৫০ বছরের গল্প সংগ্রহ' হাতে নিয়ে আমি তাই দিশাহারা বোধ করতে থাকি। একদিকে স্মৃতি, নস্টালজিয়া অন্যদিকে লেখকের তালিকা ... হ্যাঁ, প্রমথনাথ বিশী,গজা মিত্তির, মহাশ্বেতা দেবী, সমরেশ বসু বা সুনীল  আমার প্রিয় লেখকের তালিকায় না পড়লেও এদেরো যে লেখাগুলি এই সংকলনে রয়েছে সেগুলি আমাকে মুগ্ধ করে। তাছাড়া কতোযুগ পরে হাতে পেলাম সুধীন্দ্রনাথ রাহাকে, ডঃ বিশ্বনাথ রায় কে ... এই ডঃ বিশ্বনাথ রায় 'শুকতারা'য় লিখেছিলেন 'পত্রে পত্রে চঞ্চলিয়া'। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু'র জীবন অবলম্বনে উপন্যাস। মনেপড়ে সেই উপন্যাসের একেকটি পর্বের আশায় 'শুকতারা'র জন্য প্রতিমাসে পথ চাওয়া... পেলাম অরুন দে'র লেখা, দীপক চন্দ্র'র লেখা ... নামের তালিকা দীর্ঘ করার অর্থ হয়না। উৎসাহি পাঠককে বলবো বই দুটি সংগ্রহ করে নিতে।

ক-তো কাল পরে রাত জেগে পড়ে ফেলার মতো দুটি বাংলা বই যে পাওয়া গেলো ...

No comments:

Post a Comment